সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:
নারায়ণগঞ্জ মহানগরীর আওতাধীন মুল এলাকা সিদ্ধিরগঞ্জ। যেখানে সিটি কর্পোরেশনের ১নং থেকে ১০নং ওয়ার্ড রয়েছে। আর মহানগরীর মুল এলাকাটি জেলা বিএনপির কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত করেছে বিএনপি। মুলত নারায়ণগঞ্জের দুই শীর্ষ নেতার সুবিধার্থে দলের গঠনতন্ত্র না মেনেই জেলা ও মহানগর বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়। যে কারনে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির এক শীর্ষ নেতা কমিটি গঠনের পর বলেছিলেন, মহানগরীর মাথা কেটে জেলা বিএনপির লেজ বানানো হয়েছে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকাকে। গঠনতন্ত্রের মহানগরীর কোন ওয়ার্ড কমিটি যা জেলা বিএনপির ইউনিয়ন কমিটির সমমর্যাদাপূর্ণ। কিন্তু সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওয়ার্ডের কোন সভাপতির পদমর্যাদা সেই হিসেবে অনেকটা নিচে নেমে যায়। যে কারনে মামলা দায়ের করেছেন বিএনপির দুই নেতা। আংশিক কমিটি গঠনের পর বিএনপি নেতারা দাবি করেছিলেন- আসনভিত্তিক সুবিধার বিষয়টি মাথায় রেখেই কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু বিএনপির গঠনতন্ত্রে আসনভিত্তিক কমিটি গঠনের কোন নিয়ম রাখা হয়নি।
জানাগেছে, ওই ঘটনায় দলের গঠনতন্ত্র বহির্ভূত নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর বিএনপির কমিটি গঠন করায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সহ স্থানীয় আরও ৪ নেতার বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের একটি আদালতে মামলা দায়ের করেছেন বিএনপির দুই নেতা। মামলায় তারা অভিযোগ করেন-নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের এলাকা অর্থাৎ মহানগরীর ১নং থেকে ১০নং ওয়ার্ড এলাকা থেকে মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে কোন নেতাকেই রাখা হয়নি।
এই মামলায় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান মনির, সেক্রেটারি অধ্যাপক মামুন মাহামুদকে মোকাবেলা বিবাদী এবং মহানগর বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম ও সেক্রেটারি এটিএম কামালকে মুল বিবাদী করা হয়।
১৩ নভেম্বর বুধবার রাতে আদালত থেকে এ সংক্রান্ত নোটিশ বিবাদীদের হাতে পৌঁছানো হয়েছে। আগের দিন মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জ মহানগরের ১০নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি গোলজার খান ও একই ওয়ার্ডের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক (সাবেক পৌর এলাকা) বিএনপি নেতা নূরে আলম শিকদার বাদী হয়ে সিনিয়র সহকারি জজ শিউলী রানী দাসের আদালতে মামলাটি করেন।
এরপর একইদিন শুনানি শেষে পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে কেন কমিটি অবৈধ হবে না জানিয়ে বিবাদীদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন আদালত। নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সীমানা ও গঠনতন্ত্র মানা হয়নি বলেও অভিযোগ তুলেন বিএনপির ওই দুই নেতা যারা মামলার বাদী।
মামলার বাদী গুলজার হোসেন খান অভিযোগ করেন, নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটিতে অল্প ক’জন নেতা স্থান পেলেও মহানগরের কমিটিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি কপোর্রেশনের ১নং থেকে ১০নং ওয়ার্ড পর্যন্ত ১০টি ওয়ার্ডের কোনো নেতাই পদ পদবি পাননি। এই ১০টি ওয়ার্ডের মূল দলের নেতাকর্মীরা দলীয় পদ পদবির ক্ষেত্রে অবহেলার শিকার হচ্ছেন। দলের জন্য প্রাণপন কাজ করলেও দলের নেতারা তাদের কোনো পরিচয় দিচ্ছেন না। আমাদেরকে পদ পদবি যেন দেয়া হয় সেজন্যই এ মামলা। আমরা তো জাগোদল থেকেই যুক্ত বিএনপির সঙ্গে।
জানাগেছে, ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আবুল কালামকে সভাপতি ও এটিএম কামালকে সেক্রেটারি করে ২৩ সদস্য বিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ মহানগর আংশিক কমিটি গঠন করা হয় এবং একইদিন কাজী মনিরুজ্জামান মনিরকে সভাপতি ও অধ্যাপক মামুন মাহামুদকে সেক্রেটারি করে ২৬ সদস্য বিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়।
এরপর চলতি বছরের ২৩ মার্চ ২০৫ সদস্য বিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ ছাড়াও গত ৩০ অক্টোবর ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ মহারগর বিএনিপর পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেন তিনি। দুটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রেও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকাটি জেলা বিএনপির সঙ্গে অন্তর্ভূক্ত রাখা হয়। অথচ সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ১০টি ওয়ার্ড সিটি কর্পোরেশনের ১নং থেকে ১০নং ওয়ার্ড এলাকা।
কমিটি গঠনে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মুল এলাকা সিদ্ধিরগঞ্জ থানার দশটি ওয়ার্ডকে জেলা বিএনপির সঙ্গে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। যেখানে সিটি কর্পোরেশনের ১নং থেকে ১০নং ওয়ার্ড রয়েছে। জেলা বিএনপির আওতাধীন এলাকা বন্দরের ৫টি ইউনিয়ন, সদর মডেল থানার আরও দুটি ইউনিয়নকে মহানগর কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই সময় স্থানীয় নেতারা দাবি করেছেন- জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আসন ভিত্তিক সুবিধার বিষয়টি হিসেবে করেই দুটি কমিটি গঠন করা হয়।
এদিকে এ নিয়ে বিএনপির অন্যান্য অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের মধ্যেও বিরোধ সৃষ্টি হয়ে যায়। ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর বর্তমান মহানগর যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল হক মুছা সিদ্ধিরগঞ্জে একটি অনুষ্ঠান করতে গেলে যুবদলের অপর অংশের নেতাকর্মীদের মারধরের শিকার হন। তারা দাবি করেন- সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকাটি জেলা যুবদলের আওতাধীন। এ নিয়ে জেলা বিএনপির সেক্রেটারি অধ্যাপক মামুন মাহামুদকে সহ বেশকজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন মহানগর যুবদলের নেতা মঞ্জুরুল হক মুছা। ২০ নভেম্বর তৎকালীন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, জেলা ও মহানগর বিএনপির কমিটি যেভাবে হয়েছে একইভাবে অন্যান্য অঙ্গ সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি গঠন করতে হবে।
কিন্তু রিজভীর এই নির্দেশনা মানেনি নারায়ণগঞ্জ যুবদল, ছাত্রদল ও শ্রমিকদল। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকার নেতাদের রেখেই মহানগর যুবদলের কমিটি গঠন করা হয়। একইভাবে মহানগর ছাত্রদল ও শ্রমিকদলের কমিটিও গঠন করা হয়। যেখানে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকা থেকে মহানগর যুবদলের সেক্রেটারি মমতাজ উদ্দীন মন্তু, মহানগর ছাত্রদলের সেক্রেটারি মমিনুর রহমান বাবু ও মহানগর শ্রমিকদলের আহ্বায়ক এসএম আসলামকে রাখা হয়। অথচ সিদ্ধিরগঞ্জ থানার দশটি ওয়ার্ড জেলা বিএনপিতে রাখা হয় যেখানে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সদস্য সচিব অধ্যাপক মামুন মাহামুদ জেলা বিএনপির সেক্রেটারি পদে দায়িত্ব পান। তবে জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে রিজভীর নির্দেশনা মানা হয়।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর বিএনপির আংশিক কমিটি গঠনের সময় নারায়ণগঞ্জ জেলার সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান মিয়া। তিনি ওই সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন- জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আসন ভিত্তিক সুবিধার বিষয়টি হিসেবে করে কমিটি গঠন করা হয়। কারন হিসেবে তিনি দাবি করেন- সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকাটি নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লার সঙ্গে) আসনের অন্তর্ভুক্ত। তবে স্থানীয় নেতারা বলছেন- নারায়ণগঞ্জ-৪(ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশি ছিলেন শিল্পপতি মুহাম্মদ শাহআলম। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকাটি মহানগরীতে থাকলে তাকে মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সেক্রেটারির কাছে ধর্না দিতে হবে। তাই শাহআলমের কারিশমাতেই এভাবে কমিটি তার সুবিধার্থে করা হয়। কারন এ জেলায় শিল্পপতি শাহআলম কেন্দ্রীয় বিএনপির ডোনার হিসেবেই পরিচিত।
তবে মামলা হওয়ার পর ১৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার শাহজাহান মিয়ার কাছে গঠনতন্ত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহজাহান মিয়া বলেন, আমি আংশিক কমিটি গঠনের সময় দায়িত্বে ছিলাম। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের সময় দায়িত্বে ছিলাম না। পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিয়েছেন মহাসচিব। তিনি তো সরাসরি সব কিছু খোজ খরব নিতে পারেন না। এক্ষেত্রে হয়তো সাংগঠনিক সম্পাদক, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক দেখেন এবং স্থানীয় নেতারা কাজটা করেন।
তিনি মামলার বিষয়ে বলেন, যদি কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে কেউ বঞ্চিত হোন কিংবা কমিটি গঠনে কোন সমস্যা থাকে তাহলে সেটা মহাসচিবকে জানাতে পারতো। কিংবা দলের কাছে লিখিত দিতেও পারতো। কিন্তু সেটা না করে আদালতে মামলা দায়ের করাটা মনে হয় সঠিক হয়নি। তাও দলের এমন পরিস্থিতিতে। আর যেহেতু আমি দায়িত্বে নেই তাই কোন মন্তব্য করতে চাই না।
এ বিষয়ে যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিব করেননি। একইভাবে জেলা বিএনপির সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি বরাবরই মতই ফোন রিসিব করেননি।
তবে জেলা বিএনপির সেক্রেটারি অধ্যাপক মামুন মাহামুদ বলেছেন, দলের গঠনতন্ত্র মেনেই কমিটি গঠন করা হয়েছে। যারা মামলা দায়ের করেছে তারাই গঠনতন্ত্রের বাহিরে গিয়ে মামলা দায়ের করেছেন।
মহানগর বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম, কমিটি গঠনতন্ত্র মেনে বা না মেনে হয়েছে কিনা সেটা এখন আদালতের এখতিয়ার। যেহেতু মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা বিচারধীন বিষয় নিয়ে কোন মন্তব্য করব না।
মহানগর বিএনপির সেক্রেটারি এটিএম কামাল বলেন, দলের ক্রান্তিকালে আদালতে মামলা দায়ের করে বিএনপিকে কাঠগড়ায় দাড় করানোর বিষয়টি শুনে মর্মাহত হয়েছি। কারো কোন দাবি থাকলে সেটা দলকে চিঠির মাধ্যমে জানাতে পারতো। কিন্তু সেটা না করে আদালতে মামলা দায়ের করার বিষয়টি আমার কাছে মনে হচ্ছে সরকারের কোন এজেন্ট হয়ে কাজ করা।
গঠনতন্ত্র মেনে কমিটি গঠন হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা জাতীয় সম্মেলনে দলের চেয়ারপারসনকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে যে, দলের প্রয়োজনে পরিবর্তন পরিবর্ধন করতে পারবেন চেয়ারপারসন। সুতরাং দলের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত।