সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের অনেকে বেতন পাচ্ছেন না৷ সঞ্চিত অর্থ শেষের পথে, আছেন চাকরি হারানোর শঙ্কায়৷ সরকারের কোনো প্রণোদনার মধ্যেও নেই তারা৷ ফলে চলমান লকডাউনের মধ্যে মহাসংকটে পড়েছেন দেশে ‘গৃহবন্দি’ কয়েক কোটি মধ্যবিত্ত৷ অর্থনীতিবিদরা মনে করেন এইসব পরিবারের অনেকেই এখন নিম্নবিত্তের স্তরে নেমে আসছেন৷
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বার্তা সংস্থা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের চার কোটি পরিবার আছে৷ এর মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ আর উচ্চবিত্ত ২০ ভাগ৷ মাঝের যে ৬০ ভাগ এরা নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্ত৷ এই সংখ্যা আড়াই কোটি পরিবার হবে৷ এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী, মাল্টিন্যাশনাল ও বড় কোম্পানিতে কাজ করা কিছু মানুষ বাদে অন্যরা সবাই সংকটে আছেন৷ এদের মধ্যে বড় একটা অংশ চাকরি ঝুঁকিতে আছেন৷ অনেকেরই বেতন হয়নি, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে৷ ফলে তারা বেতন তো পাননি, উল্টো চাকরি ঝুঁকিতে আছেন৷ এই মানুষগুলো সরকারি কোনো কর্মসূচির মধ্যেও নেই৷ তবে সরকার এসএমই ঋণ দিয়ে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্তদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে৷ তবে এই সংখ্যাও খুব বেশি না৷ বিপুল জনগোষ্ঠী এখনও সহায়তার বাইরে৷’
অনেকের ঘরে খাবার নেই
আবু জাফর মিরপুরের কাজীপাড়ায় স্যানিটারি সামগ্রী বিক্রি করেন৷ তার দোকানে দুজন কর্মচারী৷ ২৫ মার্চ দোকান বন্ধের আগে হাতে যে টাকা ছিল তা দিয়ে কর্মচারীদের মার্চ মাসের বেতন দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন৷ সামান্য টাকা রেখেছিল নিজের পরিবারের খরচ মেটাতে৷ যা এরিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে৷ রোজগারের জন্য দোকান খুলতে পারছেন না৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে জাফর বলেন, ‘আমি কোনোভাবেই কর্মচারীদের এপ্রিল মাসের বেতন দিতে পারব না৷ নিজেই খাওয়ার জন্য এক আত্মীয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করেছি৷ এখনও বাড়ি ভাড়া দিতে পারিনি৷ মালিক চাপ দিচ্ছে৷ চার সদস্যের পরিবার নিয়ে খুবই সংকটে আছি৷ এই অবস্থা আর ১৫ দিন থাকলে আমাকে পথেই নামতে হবে৷’
আফরোজা আক্তার দর্জির কাজ করেন৷ তার স্বামী একটি দোকানের কর্মচারী৷ তিন মেয়ে নিয়ে কোনোমতে সংসার চলে তাদের৷ করোনায় স্বামী-স্ত্রীর কোনো কাজ না থাকায় তীব্র খাবার সংকটে পড়েছেন এই দম্পতি৷ ডয়চে ভেলেকে আফরোজা বলেন, নিরুপায় হয়ে তিনি স্থানীয় থানার ওসিকে ফোন দিয়েছিলেন৷ ওসি অপারগতা প্রকাশ করেন৷ পরে ওই এলাকার কাউন্সিলর কিছু সাহায্য দেওয়ার আশ্বাস দিলেও চারদিনেও কিছু পাননি৷ পরে একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের কিছু সাহায্য দিয়েছে৷
তবে মধ্যবিত্তদের অনেকেই চক্ষুলজ্জায় মানুষের কাছে সাহায্য চাইতে পারছেন না৷ নিজেদের পরিস্থিতি বাইরের কাউকে তারা জানাতেও পারছেন না৷
সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে মধ্যবিত্ত
এমন পরিস্থিতিতে কিভাবে চলছেন দেশের কয়েক কোটি মধ্যবিত্ত? পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘মধ্যবিত্তের কিছু সঞ্চয় থাকে৷ গেল এক মাসের লকডাউনে তারা সেই সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে৷ এভাবে আরেক মাস চললে তাদের সেই সঞ্চয়ও শেষ হয়ে যাবে৷ তখন কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে? বিপুলসংখ্যক মধ্যবিত্ত এই পরিস্থিতিতে নিম্নবিত্তে পরিণত হবেন৷ সবচেয়ে বড় সংকট হবে যখন সবকিছু স্বাভাবিক হবে তখন তো বিপুল সংখ্যক মানুষ চাকরি হারাবেন৷ উন্নত দেশে তো বেকার ভাতা দেওয়া হয়৷ এখানে সেই ব্যবস্থা নেই৷ তাহলে এই মধ্যবিত্ত বেকার শ্রেণি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সরকারের যে প্রণোদনা সেখানেও কিছু মধ্যবিত্তের কোনো অবস্থান নেই৷ আবার আমাদের যে ব্যবস্থা সেখানে সরকার চাইলেও মধ্যবিত্তকে কিছু করতে পারে না৷ আসলেই বাংলাদেশে মধ্যবিত্তরা ভয়াবহ সংকটে আছেন৷’
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এই কারণেই আমরা নগদ প্রণোদনার কথা বলেছিলাম৷ আমাদের দেশে ছয় কোটি ১০ লাখ শ্রমিক আছেন৷ এর মধ্যে এক কোটি শ্রমিক দিন এনে দিন খায়৷ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কর্মসংস্থান যারা করেন তাদের সংখ্যা দুই কোটি ২০ লাখ৷ আমরা সরকারকে বলেছি, একটি পরিবারে চারজন আছেন এমন একটি পরিবারকে মাসে আট হাজার টাকা হিসেবে দুই মাসের ১৬ হাজার টাকা দিতে৷ তাতে সরকারের ২৭ হাজার কোটি টাকা লাগবে, যা জিডিপির এক শতাংশ৷ এভাবেই এই ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের সহায়তা করা যেতে পারে৷’
চাকরি হারানোর শঙ্কায় অনেকে
মোহাম্মদপুরে থাকেন আমিনুল ইসলাম ও ফাতেমা আক্তার দম্পত্তি৷ একটি ‘ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ কোম্পানিতে চাকরি করেন আমিনুল৷ তার স্ত্রী ফাতেমা একটি বেসরকারি স্কুলে চাকরি এবং টিউশন করে সংসার চালান৷ কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে তিনি বেতন পাচ্ছেন না৷ আমিনুল অর্ধেক বেতন পেয়েছেন৷ কোনোমতে চলছে সংসার, কিন্তু এখনো বাসাভাড়া মেটাতে পারেননি৷
আমিনুল জানান, সামনের মাসে বেতন দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে তার চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান৷ এমনকি চাকরি থাকবে কি না তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা৷ চলতি এপ্রিল মাসে বেতন না পেলে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই পরিবারটির৷ তাদের মতো অনেকেই আছেন চাকরি হারানোর এমন আতঙ্কে৷
সূত্র: ডয়চে ভেলে