সান নারয়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:
করোনা ভাইরাসের উপসর্গ ঠান্ডা জ্বর কিংবা অন্য কোন রোগে কারো মৃত্যু হলে সেই লাশ কয়েক ঘন্টা খাটে কিংবা মেজেতে পড়ে থাকলেও লাশ ধরতে আসেনি প্রিয়জন আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশীরাও। নারায়ণগঞ্জের একজন গিটারিস্ট তার বাড়ি দেওভোগ এলাকায় ৯ ঘন্টা লাশ পড়ে থাকলেও কেউ ধরতে আসেনি। ফতুল্লার জাহাঙ্গীর নামে এক ব্যবসায়ী ঘরের মেজে এক দিন পড়েছিল। তবুও কেউ এগিয়ে আসেনি। এমনি নারায়ণগঞ্জে লাশের দাফন কিংবা সৎকার তো দুরের কথা লাশের সামনেও আসেনি আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশীরা। আর যারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের তো তার প্রিয়জনেরাও ধরতে আসেনি। এমন বিষয়টি অমানবিক হওয়ায় এগিয়ে আসেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ।
মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১৩নং ওয়ার্ড থেকে টানা দুইবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এর আগেরবার নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা থাকাকালীন সময়ে তিনি একই ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন থেকে ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের সভাপতি। তার আপন বড় ভাই বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার।
২৭ এপ্রিল পর্যন্ত মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ ২৮টি (মুসলিম) লাশের দাফনের ব্যবস্থা করেছেন। এ ছাড়াও ৬টি হিন্দু লাশের সৎকার করেছেন যার মধ্যে তিনটি লাশের মুখ্বাগ্নি দিয়েছেন কাউন্সিলর খোরশেদ। যা ওই লাশগুলোর ছেলে সন্তানের দায়িত্ব। সন্তান হিসেবে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন খোরশেদ।
মোট ৩৪টি লাশের মধ্যে করোনায় রোগে আক্রান্ত ছিলেন ৮ জন। বাকিদের কেউ করোনা রোগের উপসর্গ নিয়ে, কেউবা হৃদরোগে কিংবা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তবুও তাদের আত্মীয়স্বজন লাশ ধরতে আসেনি। এসব লাশের দাফনের জন্য একটি টিম গঠন করেন। যেখানে আরও বেশকজন তাকে সহযোগীতা করছেন। তিনি শুধু তার ওয়ার্ডের লাশেরই নয় অন্যান্য এলাকার মৃতদেরও সৎকার ও দাফনের ব্যবস্থা করছেন। লাশের গোসলের দায়িত্বে ছিলেন সিটি কর্পোরেশনের একজন নারী ও পুরুষ স্টাফ। কাউন্সিলর খোরশেদের আহ্বানে নারী লাশগুলোর গোসলের জন্য এগিয়ে এসেছেন ফতুল্লা থানাধীন এনায়েতনগর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত সদস্য রোজিনা আক্তার।
৮ এপ্রিল আফতাব উদ্দীন নামে একজন করোনা রোগীর মৃত্যু হলে বাসায় কয়েক ঘন্টা পড়েছিল। কিন্তু তার ছেলে সন্তানরা কেউ এগিয়ে আসেনি। খবর পেয়ে খোরশেদ গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে মাসদাইর কেন্দ্রীয় করবস্থানে দাফন করেন। এরপর শুরু হয় একের পর এক লাশ দাফন ও সৎকার। গত শুক্রবার সারা দিনে মোট ছয়টি লাশের পাশে ছিলেন এ কাউন্সিলর।
দেশে করোনাভাইরাসের বিস্তারের শুরুর দিকে ৯ মার্চ এ জনপ্রতিনিধি লিফলেট বিতরণ এবং জুমার নামাজে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করেন। ১৮ মার্চ থেকে নিজ উদ্যোগে ৬০ হাজার হ্যান্ড স্যানিটাইজার বোতল বানিয়ে তা বিতরণ করেন। ৩০ মার্চ লাশ দাফন ও দাহ করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমতি পেতে আবেদন করেন (অনুমতি পাওয়ার জন্য বসে না থেকে কাজ শুরু করেন)। এ জনপ্রতিনিধি নারায়ণগঞ্জে একটি ল্যাব স্থাপনেরও আবেদন করেন।
এ বিষয়ে কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদের কাছে জানতে চাইলেন তিনি বলেন, বর্তমাানে শুধু নিজের ওয়ার্ড না অন্য ওয়ার্ডে কেউ মারা গেলেও ডাক পড়ছে, এমনকি ঢাকা থেকে লাশ আনার দায়িত্বও পড়ছে অনেক ক্ষেত্রে। প্রতিটি লাশের তথ্য থানায় জানানো হচ্ছে এবং দলের সদস্যরাও হিসাব রাখছেন।
মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ বলেন, ‘দেশের এই পরিস্থিতিতে কেউ মারা গেলে স্বজনেরাও ভয়ে কাছে যায় না। লাশ যাতে পড়ে না থাকে, যার যার ধর্ম অনুযায়ী যাতে লাশ দাফন বা সৎকার করা যায়, সেই চেষ্টা থেকেই ব্যক্তিগতভাবে কাজ শুরু করছিলাম। বর্তমানে সিটি করপোরেশনের মেয়র থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, ফতুল্লা থানা সহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর থেকে সহায়তা পাচ্ছি। আমার পরিবার থেকে প্রথম দিকে আপত্তি আসছে, কিন্তু এখন সবাই মেনে নিছে। এ কাজ করে বাড়িতে ফিরে আমি সবার থেকে আলাদা থাকার চেষ্টা করি। দুবার করোনা টেস্ট করছি, এখন পর্যন্ত দুবারই তা নেগেটিভ আসছে। আর আমার সঙ্গে এ কাজে অন্য স্বেচ্ছাসেবকেরা জড়িত, তাই কাজটা আমি হুজুগে করি না। কাজ শুরুর আগে ধর্মীয় নেতাদের পরামর্শ নেওয়ার পাশাপাশি সবার নিজেদের সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দিছি। আমি তো এ কাজের জন্য কাউরে বিপদে ফেলতে পারি না।’
মাকছুদুল আলম বলেন, ‘এখন স্বাভাবিক মৃত্যুর পরও পরিবারের স্বজনেরা ফোন দিচ্ছেন। তবে আমি বা আমরা এত লাশের দায়িত্ব নিয়া তো জানে কুলাইতে পারব না। একসময় তো তাইলে এইটাই পেশা হয়ে যাইব। তা এখন না করি।’
তার সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক আরিফুজ্জামান হীরা, হাফেজ আকরাম, জুনায়েদ সহ অন্যদের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্টে লিখেছেন তিনি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মো. শফিউল্লাহর কথা লিখেছেন ফেসবুকে। জানিয়েছেন, এ তরুণ নিজের জমানো টাকা দিয়ে পুরোনো একটি পিকআপ ভ্যান কিনেছিলেন এবং তা নিজেই চালান। এই তরুণ মরদেহ বহনের পাশাপাশি লাশের শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নেবেন বলে জানান এবং এ কাজের জন্য তিনি ভ্যানের ভাড়া নেবেন না বলেও জানান। ফেসবুকে শফিউল্লাহকে ‘স্যালুট’ জানিয়ে মাকছুদুল আলম খোন্দকার লিখেছেন, এ তরুণ ভাড়া নিতে না চাইলেও তরুণের পড়াশোনা খাতে পাশে দাঁড়াবেন তিনি।
এদিকে মাকছুদুল আলম খোন্দকার বলেন, ‘দিনে পাঁচটি বা একটি লাশ যা–ই হোক, সবার শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায় আমি উপস্থিত থাকি, যতটুকু পারি কাজে সাহায্য করি। দলের অন্য স্বেচ্ছাসেবকেরা এতে কাজে উৎসাহ পান। অন্যদিকে কেউ যাতে ভাবতে না পারেন আমি নিরাপদে ঘরে বসে খালি মাতব্বরি করছি।’
অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমান এক সংবাদ সম্মেলনে কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদকে দেশের বীর বাহাদুর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ ছাড়াও তার বিষয়টি নিয়ে মিডিয়াতে ব্যাপক প্রশংসা করেছেন নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের আওয়ামীলীগের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানও।
মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদের ভালো কাজের বিষয়টিকে স্যালুট জানিয়ে ২২ এপ্রিল ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন নেদারল্যান্ডসের একজন সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদ জোরাম ভান ক্লাভেরি।
খোরশেদের এমন ভুমিকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জের আওয়ামীলীগ বিএনপি ও জাতীয় পার্টি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দও প্রশংসা করে ফেসবুকে তাকে তুলে ধরছেন।