সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম
করোনা উপসর্গ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগরীর জামতলার বাসিন্দা আফতাব উদ্দিন (৬৫) মারা যাওয়ার পর লাশটা ঘরে তালাবদ্ধ করে রেখেছিল পরিবারের সদস্যরা। দাফন-কাফন তো দূরের কথা মারা যাওয়ার পর আফতাব উদ্দিনকে একনজর কেউ দেখতেও আসেনি।
গত বছর ৭ এপ্রিল করোনার কঠিন সময়ে এগিয়ে এসেছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে তিনি ও তার দলের লোকজন পিপিই পরিধান করে আফতাব উদ্দিনের লাশ দাফনের ব্যবস্থা করেন। সেবা দিতে গিয়ে তিনি ও তার স্ত্রী আক্রান্ত হন করোনায়। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসেন তার স্ত্রী।
শুধু আফতাব উদ্দিন নয়; গেল বছরে করোনা কিংবা করোনা উপসর্গ নিয়ে একে একে ১৪৪ জনের লাশ দাফন করেন কাউন্সিলর খোরশেদ ও তার টিমের সদস্যরা। এদের কেউই তার রক্তের কোনো স্বজন নয়। বিপদকালে মানবতাকে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে আসেন খোরশেদ। করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া হিন্দু ধর্মাবলম্বীর লাশ সৎকারে মুখাগ্নি করেছেন কয়েকজনের।
মহামারী করোনা সংক্রমণের শুরুটা নারায়ণগঞ্জ থেকে। গেল বছর করোনার ক্লাস্টার নগরী হিসেবে পরিচিতি পায় এ জেলা। করোনায় আক্রান্ত ও উপসর্গে মৃত ব্যক্তিদের লাশ পড়েছিল বাড়ির আঙিনায়, সিঁড়িতে। সংক্রমণের ভয়ে স্বজন ও প্রতিবেশীরা কেউ লাশ দাফনে এগিয়ে আসেনি। ওই পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাশ দাফন ও সৎকারে এগিয়ে আসেন মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। পাশে দাঁড়ানোর জন্য খোরশেদের মতো এমন মানুষ এর আগে দেখেননি নারায়ণগঞ্জবাসী।
জানা যায়, করোনার শুরু থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি ও বিতরণসহ নানা উদ্যোগে নারায়ণগঞ্জবাসীর পাশে ছিলেন আলোচিত এই কাউন্সিলর। আগামীতেও মানবসেবার এই কাজ চালিয়ে যেতে চান তিনি। এই কাজ করতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতা, সহযোগিতাসহ নানা বিষয় নয়া দিগন্তের কাছে তুলে ধরেন তিনি।
গত বছর ৯ মার্চ নারায়ণগঞ্জে করোনা ও ডেঙ্গু সচেতনতায় লিফলেট ও মাস্ক বিতরণ শুরু করেন খোরশেদ। ১৮ মার্চ তার বন্ধু, সহকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে ৬০ জনের টিম গঠন করেন খোরশেদ। দেশে প্রথম করোনায় মৃত্যুর খবর পেয়ে শহরের পাইকারি ওষুধের দোকান কালীরবাজারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার সংগ্রহে যান; কিন্তু সেখানে কোনো দোকানে হ্যান্ড স্যানিটাইজার পাননি। পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন থেকে ফর্মুলা নিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরির উদ্যোগ নেন। বিকন ফার্মার ফার্মাসিস্ট বন্ধু আসাদুজ্জামান চৌধুরীর দেখানো ফর্মুলায় তা বানাতে শুরু করেন। ৬০ হাজার বোতল হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি ও বিতরণ করেন। ১০ হাজার বোতল বাংলা লিকুইড সাবান তৈরি করেন।
খোরশেদ জানান, গত ২২-২৩ মার্চ ঢাকায় করোনা ও করোনা উপসর্গে মৃত্যু বৃদ্ধির কারণে অমানবিক ঘটনা ঘটতে থাকে। সংক্রমণের ভয়ে লাশ দাফনে বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটতে থাকে। আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে লাশ দাফন শুরু করেন। সেই থেকে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে আশঙ্কা করে তিনি লাশ দাফনে উদ্যোগী হন। তিনি বলেন, আতঙ্কের কারণে লাশ দেখা হয়নি। পরে ভিডিও ফুটেজ দেখে চিনতে পারেন ওই ব্যক্তি তার কাছের পূর্বপরিচিত। তারপর একের পর এক জেলায় ৮০টি লাশ এবং গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনা ও করোনা উপসর্গে মৃত ১৪৪টি লাশ দাফন করেন।
করোনা উপসর্গে মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনের প্রথম অভিজ্ঞতা নিয়ে খোরশেদ বলেন, লাশ আনার জন্য পিকআপ ভ্যান নিয়ে যান। করোনা উপসর্গে মারা গেছে জানতে পেরে ওই পিকআপ ভ্যানের চালক গাড়ি ফেলে পালিয়ে যান। পরে তারা ওই বাড়ি থেকে লাশ নিয়ে দাফন করেন।
করোনা সঙ্কটের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে খোরশেদ বলেন, ‘শহরের আমলাপাড়া এলাকায় গত ১৪ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত একই পরিবারের একাধিক সদস্যের করোনায় মৃত্যু হয়েছে। ওই ঘটনায় অনেক ভয় পেয়েছি। বাবা মারা গেছে, ভয়ে সন্তান বা প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসছে না। আমরা যখন তাদের পাশে দাঁড়াই তখন ওই পরিবারগুলোর চোখে প্রশান্তি দেখতে পাই। এতে আমরা উৎসাহিত হই।’
করোনা রোগীর লাশ দাফনের একপর্যায়ে খোরশেদ ও তার স্ত্রী আফরোজা আক্তার লুনা করোনায় আক্রান্ত হন। শ্বাসকষ্ট বেড়ে পরিস্থিতি খারাপ হলে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন। স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে সেখানে প্লাজমা দেয়ার বিষয়টি জানতে পারেন। তখন তিনি রোগীদের প্লাজমা দেয়ার উদ্যোগ নেন। এ পর্যন্ত তারা ১০৩ জনকে প্লাজমা দিয়েছেন। ১৩২ জনকে দিয়েছেন অক্সিজেন সহযোগিতা। তাদের আছে সাতটি অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং একটি কনসেন্ট্রেটর।
তিনি বলেন, অক্টোবর-নভেম্বরে চাপ কম ছিল। এখন চাপ বেড়েছে। তবে সংক্রমণ আগের চেয়ে কম। টিম খোরশেদকে সাপোর্ট দিতে মডেল ডি ক্যাপিটাল রোগী ও লাশ বহনে অ্যাম্বুলেন্স, পুষ্টি সহযোগিতার জন্য সবজি, ডিম, বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে গড়ে একজনের মতো লাশ দাফন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, যত দিন করোনা সঙ্কট থাকবে, তত দিন তাদের এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।
খোরশেদের স্ত্রী লুনা জানান, করোনাকালে তিন মাস তার স্বামী খোরশেদ আলাদা ছিলেন। মানবিক কাজেই ছিলেন। তিনি বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর বুঝতে পেরেছি মানুষ কত অসহায়। যত দিন করোনা পরিস্থিতি থাকবে, তত দিন খোরশেদ মানুষের পাশে থাকবে এই উপলব্ধি আমাকে অনুপ্রাণিত করে।