ফ্রেরুয়ারী আমাদের ভাষা ও ত্যাগের মাস, মহান স্বাধীনতার বীজ রোপনের মাস। আমি নারায়নগঞ্জ সহ সারা দেশের সকল ভাষা সৈনিক ও ভাষার দাবীতে সকল শহীদ’দের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। ১৯৫২ সাল থেকে ২০০৪ পর্যন্ত নারায়নগঞ্জে যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ দিবস পালিত হলেও নারায়ণগঞ্জে কেন্দ্রীয় ভাবে স্থায়ী কোন শহীদ মিনার ছিল না।
তবে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দের একান্ত চেষ্টায় চাষাড়া কেন্দ্রীক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে শহীদ মিনার ছিল। শেষের দিকে পূর্ণাঙ্গ অবয়বে না হলেও বর্তমান শহীদ মিনার চত্বরে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে। ফলে নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ ও জনগনের দীর্ঘদিনের দাবী ছিল একটি স্থায়ী ও পূর্নাংগ শহীদ মিনার। যেখানে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি ভাষার শুদ্ধ চর্চা তথা একটি সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে উঠবে।
দীর্ঘদিন পরে ২০০৩ সালে নারায়নগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনের পরে একটি পূর্নাংগ শহীদ মিনার করার সিদ্ধান্ত নেয় নব নির্বাচিত পৌর পরিষদ। চাষাড়ার যেখানে অস্থায়ী ও অপূর্নাংগ শহীদ মিনারটি ছিল সেই জায়গাটি আমার ওর্য়াডের মধ্যে। পূর্বের জায়গাই সর্বসম্মতিক্রমে শহীদ মিনার স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। শহীদ মিনার নির্মানের জন্য নারায়নগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট দশ হাজার টাকা পৌরসভায় অনুদান দেয়। মেয়র মহোদয়ের নির্দেশক্রমে আমি সংশ্লিষ্ট ওর্য়াড কাউন্সিলর হিসাবে তদারকি ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়ে নিজেকে আমি চরম ভাগ্যবান ও গর্বিত মনে করি।
নকশা প্রনয়ন, টেন্ডার আহবান করে ঠিকাদার নিয়োগের পরে ২০০৪ সালের ৮ই জানুয়ারী আনুষ্ঠানিক ভাবে শহীদ মিনারের ভীত তৈরীর জন্য মাটি কাটার কাজ শুরু হয়। মেয়র মহোদয়ের অনুমতিক্রমে আমি কোদাল হাতে মাটিতে কয়েকটি কোপ দিয়ে ও মোনাজাতের মাধ্যমে কাজের উদ্বোধন করি। তখন আরো উপস্থিত ছিলেন পৌরসভার তৎকালীন তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খাইরুল ইসলাম সহ সংশ্লিষ্ট উপ-সহকারী প্রকৌশলী আওলাদ হোসেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কদম রসুল কনস্ট্রাকশনের মালিক এমরান হোসেন সহ অনেকে। ১২ই জানুয়ারী প্রথম ঢালাই কাজও আমার হাতে শুরু হয়।
এরইমধ্যে চলে আসে মহান ভাষা দিবস ২১শে ফ্রেরুয়ারী। সেইবার অর্ধ সমাপ্ত শহীদ মিনারেই নারায়ণগঞ্জবাসী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। এভাবেই দিনে দিনে এগিয়ে যায় নারায়ণগঞ্জবাসীর স্বপ্ন যাত্রা। ধীরে ধীরে একটি পূর্নাংগ শহীদ মিনারে অবয়ব ফুটে উঠতে শুরু করে। এরই মধ্যে ১২ই জুন শহীদ মিনারের কাজের অগ্রগতি পরির্দশনে আসেন পৌর মেয়র ডাঃ সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তৎকালীন জেলা প্রশাসক হারুনার রশীদ।
শেষ হয় অপেক্ষার পালা। অবশেষে ৩০শে নভেম্বর’২০০৪ ঠিকাদার কাজ শেষ করে পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে একটি পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনার হস্তান্তর করে। নামকরন করা হয় ”নারায়নগঞ্জ কেন্দ্রীয় পৌর শহীদ মিনার”। আজ সেই শহীদ মিনার নারায়ণগঞ্জবাসীর শিক্ষা সাংস্কৃতির পীঠস্থান। শহীদ মিনার নির্মাণে আমার ভূমিকা অনেকই হয়তো জানে না, আবার অনেকে জেনেও মানেন না। তারপরেও এই শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে যখন যাই, যখন দেখি হাজার মানুষ এখানে শহীদদের শ্রদ্ধা জানায়, যখন দেখি শিক্ষা সাংস্কৃতি সহ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ এবং শতশত তরুণের পদভারে মুখরিত থাকে শহীদ মিনার চত্বর, তখন নিজের অজান্তেই বুকের মধ্যে গর্ব অনুভব করি এই ভেবে যে আমি এই মহান কাজটির সাথে প্রতোক্ষ্য ভাবে আমি সংশ্লিষ্ট ছিলাম। এই গর্ব শুধু আমার একার নয়, এই গর্ব আমাদের ১৩ নং ওয়ার্ডবাসীর সবার। কারণ তাদের প্রতিনিধি হিসাবেই এই মহৎ কাজে আমার অংশগ্রহন। মানুষের মনে ঠাই না হলেও পৌরসভার দলিল দস্তাবেজে নিশ্চই আমার নামটি থেকে যাবে, যতদিন আমাদের মায়ের ভাষা থাকবে, যতদিন আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব থাকবে,ইনশাল্লাহ।
আগে শহীদ মিনার লাগোয়া পশ্চিম দিকের রাস্তাটির কোন নাম ছিল না। এলাকাবাসী বালুরমাঠ নামে জানতো। শহীদ মিনারের কাজ শেষ হওয়ার পরে আমার প্রস্তাবেই পৌর পরিষদ সড়কটির নাম করন করে “শহীদ ভাষা সৈনিক সড়ক”। তাছাড়া আরো একটি সড়কের নাম একজন ভাষা সৈনিকের নামে নাম করনের প্রস্তাবকও আমি ছিলাম। যার সকল লিখিত রের্কড নাসিকে রক্ষিত আছে।
তথাপিও সম্পূর্ন কৃতিত্ব তাদের, যারা ১৯৫২ থেকে ২০০৩ পর্ষন্ত নারায়নগঞ্জে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য শহীদ মিনারের ব্যাবস্থা করেছিলেন এবং দাবী তুলেছিলেন একটি পূনাংগ ও স্থায়ী শহীদ মিনারের। নারায়নগঞ্জের ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনারের দীর্ঘ ও বন্যার্ঢ্য ইতিহাস রয়েছে। আমার সংক্ষিপ্ত লেখায় তা উল্লেখ করা সম্ভব হলো না বিধায় আমি সংশ্লিষ্টদের কাছে কড়জোর ক্ষমা প্রাথী।
লেখক: মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ
কাউন্সিলর, ১৩নং ওয়ার্ড, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন