সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার বিএনপির রাজনীতি বলতে এক সময় বুঝানো হতো প্রয়াত বিএনপির নেতা এমএ বদরুজ্জামান খান খসরু ও তার ভাই সাবেক এমপি আতাউর রহমান খান আঙ্গুর। দুই ভাইয়ের পারিবারিক রাজনীতি ছিল দীর্ঘদিন। দুই ভাইয়ের বিরোধই ছিল বিএনপির প্রধান বাধা। খসরুর মৃত্যুর পর নতুন করে আলোচনায় একজোড়া চাচা-ভাতিজার রাজনীতিতে বন্ধি বিএনপি। এবার নতুন করে জোট হয়েছে স্বামী-স্ত্রীর বিএনপি।
নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, আড়াইহাজার বিএনপির ছিল দুই ভাগে বিভক্ত। একপক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন আঙ্গুর, আরেক পক্ষের নেতৃত্বে তারই ভাই খসরু। দীর্ঘদিন এমনটা চলার পর আড়াইহাজার বিএনপিতে উদয় হোন কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ। তার সুবাদে তারই চাচা লুৎফর রহমান আব্দু হয়ে যান জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি। বর্তমান জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফর রহমান আব্দুু। তার রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড বলতে কেবল ভাতিজা নজরুল ইসলাম আজাদ।
এদিকে খসরুর মৃত্যুর পর নিজেকে আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পরিচয় দিচ্ছেন তারই ছেলে মাহমুদুর রহমান সুমন। খসরু ছিলেন আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির সভাপতি, সেক্রেটারি ছিলেন হাবিবুর রহমান ও সিনিয়র সহ-সভাপতি মীরজুল হাসান নয়ন মোল্লা। কার্যত নয়ন মোল্লাই ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সাংগঠনিক নিয়ম। কিন্তু সুমনের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা বিএনপির সদস্য জুয়েল আহাম্মেদ বলেছেন, সুমন ভারপ্র্রাপ্ত সভাপতি না। এটা ভুয়া। মনে হচ্ছে সে এখন পৈত্রিক সূত্রে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দাবি করছেন। কারন তার পিতা ছিলেন সভাপতি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মীরজুল হাসান নয়ন মোল্লা সান নারায়ণগঞ্জকে বলেছেন, আসলে এখন রাজনীতির পরিবেশটা নাই। তাই রাজনীতি থেকে একটু নীরব রয়েছি। সুমন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কিভাবে হলো সেটা সে বলতে পারবে। তবে শুনেছি তৈমূর সাহেব নাকি এককভাবে গোপনে আরেকটি কমিটির অনুমোদন দিয়েছিলেন সেখানে সুমনের নাম নাকি রয়েছে। তবে এসব বিষয় নিয়ে এখন কথা বলতে চাইনা। কারন রাজনীতি থেকে দুরে আছি।’
আড়াইহাজারে সভাপতি ও সেক্রেটারি কে কে রয়েছেন জানতে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অধ্যাপক মামুন মাহামুদ বলেন, খসরু সাহেবের মৃত্যুর পর আমরা আড়াইহাজারে ধরে নিয়েছি সেখানে কমিটি সাইলেন্স। আমরা অচিরেই সেখানে আহ্বায়ক কমিটি দিব। যেহেতু কমিটি দিব, তাই পুরনো কাসন্দি ঘাটাঘাটি করে বিতর্ক সৃষ্টি করতে চাই না। আমরা নতুন কমিটি দিব এটাই ফাইনাল।
অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপির দলীয় প্রার্থী হিসেবে যার ভরাডুবি হয়েছিল সেই কেন্দ্রীয় মহিলা দলের সাংগঠনিক সম্পাদক পারভীন আক্তার। অথচ সেই পারভীন আক্তার তার স্বামী আনোয়ার হোসেন অনুর জন্য খসড়া কমিটি জমা দিয়েছেন। যাদের পৌর এলাকায় নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা প্র্শ্নবিদ্ধ সেই তারা স্বামী-স্ত্রী আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির খসড়া কমিটি জমা দিলেন।
তবে নেতাকর্মীরা বলছেন- এর পেছনে ভিন্ন কারন, তা হলো আড়াইহাজারে কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মাহমুদুর রহমান সুমনকে চাপে রাখার একটি বিরাট ফর্মূলা। কারন এই দুই নেতা আড়াইহাজারের কমিটি ভাগিয়ে নিতে জেলা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের ম্যানেজ করে চলছেন। সুমন সার্বক্ষনিক কেন্দ্রীয় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহাম্মেদের সঙ্গে জম্পেস আড্ডায়।
আজাদের সঙ্গে জিয়া পরিবারের এক সদস্যের সঙ্গে রয়েছে তার ঘনিষ্ঠতা। ফলে জেলা বিএনপির নেতাদের তোয়াক্কা না করায় কৌশলে পারভীনকে মাঠে নামানো হয়েছে। এর আগে ওই আসনে পারভীন আক্তার জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের আশাবাদ ব্যক্ত করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। অথচ পৌর নির্বাচনে তার ভরাডুবি ঘটেছিল। তবে এসবের পেছনে জেলা বিএনপির আস্কারা রয়েছে সেটাও প্রমাণিত হয়েছে যখন নজরুল ইসলাম আজাদ ও মাহমুদুর রহমান সুমন এবং তাদের অনুগামী নেতাদের বাদ দিয়ে জেলা বিএনপির নেতাদের হাতে খসড়া কমিটি ধরিয়ে দিল এবং নেতারাও তা গ্রহণ করে নিলেন।
জানাগেছে, গত ১৭ মার্চ আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠনের লক্ষে ঢাকা বিভাগীয় কেন্দ্রীয় মহিলা দলের সাংগঠনিক সম্পাদক পারভীন আক্তার তার স্বামী আনোয়ার হোসেন অনুকে আহ্বায়ক করে খসড়া কমিটি জমা দেন। একই দিন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার, সদস্য সচিব মামুন মাহামুদ ও যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদ হাসান রোজেলের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন তার স্বামী-স্ত্রী। ওই সময় আড়াইহাজার বিএনপির বেশকজন নেতাকর্মী সঙ্গে ছিলেন।
আড়াইহাজার উপজেলা কমিটি গঠনের দায়িত্বে থাকা উপ-কমিটির প্রধান নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক জাহিদ হাসান রোজেলের কাছে খসড়া কমিটির তালিকা জমা দেন পারভীন।
পরবর্তীতে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহবায়ক অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার ও সদস্য সচিব অধ্যাপক মামুন মাহমুদ সঙ্গে সাক্ষাত করে এ বিষয়ে অবগত করেন।
তার দেয়া কমিটিতে আড়াইহাজার উপজেলা বিআরডিবি’র সাবেক চেয়ারম্যান ও নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক অর্থ বিষয়ক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন অনু ও সদস্য সচিব পদে মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ চেয়ারম্যান।
এছাড়াও কমিটিতে রয়েছেন সাতগ্রাম ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি অ্যাডভোকেট আহজহারুল ইসলাম জাহাঙ্গীর, আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোরশেদ মোল্লা, হাইজাদী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি সফিউল আলম সবুজ, হাইজাদী ইউনিয়ন বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট মামুন মাহমুদ, আড়াইহাজার উপজেলা ওলামাদলের সেক্রেটারি শাহাজালাল মিয়া সহ আরো বেশকজন।
নেতাকর্মীরা বলছেন- আড়াইহাজারে এত্তসব নেতা থাকার পরেও আড়াইহাজারে বিএনপির কার্যালয়ে একটি কর্মসূচিও পালন করতে পারেনি তারা। অথচ সেখানে বিএনপির দুটি কার্যালয়। যার একটি প্রতিষ্ঠা করেছেন খসরু ও আরেকটি আঙ্গুর। দুটি কার্যালয়ের তালাও খুলতে পারেনি সেখানের বিএনপি নেতারা। অথচ নিজেদের মধ্যে কমিটি ও কমিটির পদ পদবী অনুগতদের দিয়ে ভাগিয়ে নিতে চলছে লড়াই। আড়াইহাজার বিএনপির কমিটি নিয়ন্ত্রনের লড়াইয়ে এখন কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মাহমুদুর রহমান সুমন। যেখানে আঙ্গুর রয়েছেন নীরব। কিন্তু সরব এখন পারভীন ও তার স্বামী অনু।
সূত্রেমতে, ১/১১ এর কঠিন সময়ে জিয়া পরিবারের রাজনীতি বাদ দিয়ে সংস্কারবাদীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন বিএনপির একাধিকবার নির্বাচিত সাবেক এমপি আতাউর রহমান আঙ্গুর। অথচ তিনি ছিলেন একটি ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি। সেখান থেকে তাকে বিএনপিতে নিয়ে আসেন প্রয়াত খসরু। কয়েক বছর পূর্বে আবারো দলে নেয় আঙ্গুরকে। কিন্তু রাজপথের আন্দোলনে সংগ্রামে তার কোন হদিশ পাওয়া যায়নি। যদিও জেলা বিএনপির বিগত কমিটিতে তাকে সদস্য পদে রাখা হয়েছিল। বর্তমান কমিটি হওয়ার আগে জেলা বিএনপির সভাপতি পদে চেয়ে আঙ্গুরের পোস্টার ছেয়েছিল জেলায়।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রাথমিকভাবে আতাউর রহমান আঙ্গুর, নজরুল ইসলাম আজাদ ও মাহমুদুর রহমান সুমন মনোনয়ন পায়। কিন্তু চূড়ান্তভাবে নজরুল ইসলাম আজাদকে মনোনয়ন দেয়া হয়। এর বছর দেড়েক আগে মৃত্যুবরণ করেন বদরুজ্জামান খান খসরু। তার মৃত্যুর পর হটাত করে বিএনপির রাজনীতিতে উদয় হয় মাহমুদুর রহমান সুমনের। যাকে এর আগে রাজপথের আন্দোলনে তো দুরের কথা বিএনপির মানববন্ধনেও দেখা মিলেনি। জোর করে হয়ে যান আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। তার পিতা খসরু ছিলেন আড়াইহাজার বিএনপির সভাপতি। একই সঙ্গে জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক।
২০০৯ সালের ২৫ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি হোন অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার ও সেক্রেটারি কাজী মনিরুজ্জামান মনির। কমিটি গঠনের কয়েক মাসের মাথায় আড়াইহাজারে বদরুজ্জামান খান খসরুকে সভাপতি ও হাবিবুর রহমান হাবুকে সেক্রেটারি করে একটি কমিটি দেন তৈমূর ও কাজী মনির। যে কমিটিতে সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে মীরজুল হাসান নযন মোল্লা ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে অ্যাডভোকেট খোরশেদ আলম মোল্লাকে রাখা হয়।
২০১৩ সালের দিকে আড়াইহাজারে ধীরে ধীরে উদয় হয় নজরুল ইসলাম আজাদ। ওই সময় থেকে হাবিবুর রহমান হাবু খসরুর নিয়ন্ত্রনের বাহিরে চলে যেতে থাকেন। এক পর্যায়ে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে হাবুকে শোকজ করা হয়। শোকজের জবাব না দেয়ায় হাবুকে অব্যাহতি দিয়ে আব্দুল কাশেম ফকিরকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বসান তৈমূর আলম খন্দকার। পরবর্তীতে খসরুর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়ান হলে তৈমূর আলম মৌখিকভাবে হাবুকেই সেক্রেটারি পদে থাকার বৈধতা দেন বিভিন্ন কর্মসূচিতে। তারপর থেকে দুজনই সেক্রেটারি পরিচয় দেয়। হাবু একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। আজাদের সঙ্গে রাজনীতিতে জড়িতদের বেশির ভাগ বিতর্কিত। আজাদের ছোট ভাইও কদিন আগে বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হয়েছিল।
গত নির্বাচনের পূর্বে আজাদের বিরুদ্ধে জিডিও করেছিল হাবু। কাশেম ফকিরকে ফুলের মালা দিয়ে আওয়ামীলীগে বরণ করেছিল স্থানীয় আওয়ামীলীগের এমপি। যে ছবি জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির প্রথম সভায় তুলে ধরেছিলেন আড়াইহাজার বিএনপির সাবেক সেক্রেটারি ইউসুফ আলী ভুঁইয়া। সভার মাঝখানেই সভাস্থল ত্যাগ করেছিলেন কাশেম ফকির। কাশেম ফকির ও হাবু জেলা বিএনপির সদস্য।
এমন পরিস্থিতিতে খসরুর মৃত্যুর পর খসরুর অনুগত নেতাকর্মীদের নিয়ে বৈঠক করে খসরুর ছেলে মাহমুদুর রহমান সুমন নিজেই আড়াইহাজার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হয়ে যান। কার্যত দলীয় নিয়মে সিনিয়র সভাপতি মীরজুল হাসান নয়ন মোল্লাকেই ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করার কথা।