সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও রয়েল রিসোর্টে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা মামুনুল হক এক নারী সহ অবরুদ্ধের ঘটনায় নাশকতার বিষয়ে দায়ের করা হয় ৭টি মামলা। এসব মামলায় রাজনৈতিকভাবে ফাঁসাতে প্রতিপক্ষের অনেককেই আসামি করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব এজাহার দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠেছে। শুধু তাই নয় উপজেলা ছাত্রলীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক মাইদুল ইসলাম শান্তকেও উপজেলা আওয়ামীলীগের কার্যালয় ভাংচুর মামলায় আসামি করা হয়েছে।
এসব বিষয় নিয়ে ২৪ এপ্রিল শনিবার জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ’সোনারগাঁওয়ে মামুনুল হককে আটকের ঘটনা, বানোয়াট এজাহারে অর্থবাণিজ্যের হিড়িক!’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এই সংবাদে সোনারগাঁয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। পাঠকদের সুবিধার্থে ইত্তেফাকের সংবাদটি হুবহু সান নারায়ণগঞ্জে প্রকাশ করা হলো।
সোনারগাঁওয়ে মামুনুল হককে আটকের ঘটনা, বানোয়াট এজাহারে অর্থবাণিজ্যের হিড়িক!
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে এক নারীসহ হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হককে আটকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রয়েল রিসোর্টে হামলা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও দলটির স্থানীয় একাধিক নেতার বাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুরের ঘটনায় এখন সেখানে চলছে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ। অভিযোগ উঠেছে, এসব ঘটনাকে পুঁজি করে বহুধা বিভক্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গ্রুপের কেউ কেউ মামলার ভুয়া এজাহার বানিয়ে রীতিমতো অর্থ বাণিজ্যে মেতেছেন। এসব ‘এজাহার’ মানুষজনের বাড়িতে-বাড়িতে পাঠিয়ে অর্থের বিনিময়ে নাম কাটানো কিংবা নাম ঢুকানো চলছে। এতে নাম অন্তর্ভুক্তির আতঙ্কে এলাকার শত-শত নিরীহ ও রাজনৈতিক কর্মী এখন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ভুয়া এজাহারের বিষয়টি এখন সোনারগাঁওয়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। এগুলোর কয়েকটি কপি ইত্তেফাকের কাছেও এসেছে। সোনারগাঁও উপজেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের কেউ কেউ পুলিশকে পাশ কাটিয়ে এবং নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মীদের মামলায় জড়াচ্ছেন। রাজনীতি করেন না, তবে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল এমন নিরীহ লোকজনকেও জড়ানো হচ্ছে টাকা আদায়ের উদ্দেশ্যে। তারা থানায় মামলা রুজুর আগেই নিজেরা অভিযোগ আকারে এজাহার তৈরি করে সেখানে টার্গেটকৃত লোকদের আসামি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পরে নাম ধরে-ধরে কাউকে কাউকে দেখা করতে বলছেন। কেউ কেউ আতঙ্কে দেখা করে অর্থ দিয়ে ‘নাম কাটিয়েছেন’। যারা অর্থ দিতে পারেনি তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আওয়ামী লীগ ছাড়াও সংসদের প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টির (জাপা) স্থানীয় নেতা-কর্মীদেরও আসামি করা হয়েছে।
সোনারগাঁওয়ে হেফাজতের ভাঙচুরের মামলায় ১৮ এপ্রিল গ্রেফতার কার হয়েছে উপজেলা জাপার সভাপতি আব্দুর রউফকে। তিনি উপজেলার শম্ভুপুরা ইউনিয়ন পরিষদেরও চেয়ারম্যান। তিনি উপজেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি। পরে জাপায় যোগ দেন। এছাড়াও গ্রেফতার করা হয়েছে সোনারগাঁও পৌরসভার কাউন্সিলর ফারুক আহমেদ তপনকে। তিনি ৮নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তপন একসময় উপজেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে জাপার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এদিকে, সোনারগাঁওয়ে আটক জাপার নেতাদের মুক্তি এবং হয়রানি বন্ধের দাবি করেছেন দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। বুধবার এক যৌথ বিবৃতিতে জাপার নেতৃদ্বয় বলেন, গত ৩ এপ্রিল সোনারগাঁওয়ে রয়েল রিসোর্টে হামলার ঘটনায় জাপা বা পার্টির কোনো নেতা-কর্মী জড়িত নন। অথচ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে জাপার দুই নেতাকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া আরো ৩৫ নেতা-কর্মীকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। রমজান মাস ও মহামারী করোনাকালে জাপার স্থানীয় নেতা-কর্মীরা ঘরে থাকতে পারছেন না। প্রতি রাতে পুলিশ জাপার নেতা-কর্মীদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে হানা দিচ্ছে।
জানা গেছে, সোনারগাঁওয়ে ভাংচুরের ঘটনায় ইতোমধ্যে সাতটি মামলা হয়েছে। মামলাগুলো বর্তমানে তদন্তাধীন। মামলার বিষয়ে সোনারগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার ইত্তেফাককে বলেন, ‘তদন্ত শেষ হওয়ার আগে এবিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৩ এপ্রিল বিকালে হেফাজত নেতা মামুনুল হককে যখন রয়েল রিসোর্টে এক নারীসহ আটক করা হয় তখন সেখানে সেনারগাঁও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নু ও উপজেলা ছাত্রওলীগের সহ-সভাপতি হাজী শাহ আহমেদ সোহাগ (সোহাগ রনি) উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের আরও কয়েক নেতাও ছিলেন সেখানে। মামুনুলকে আটক করার পর প্রায় চার ঘণ্টা সেখানে তর্কবিকর্ত চলতে থাকে। এই ফাঁকে হেফাজতের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা সংগঠিত হতে থাকে। পরে রাতেই তারা উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় এবং নান্নু ও সোহাগ রনির বাড়িতে ভাংচুর চালায়।
সোনারগাঁও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সামশুল ইসলাম ভুইয়াও গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমাদের দলের অফিস ভাংচুর হয়েছে। এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জাপা বুঝি না। যারা অপরাধী তারা যেন শাস্তি পায়। তবে নিরীহ বা নিরপরাধ কেউ যেন হয়রানি না হন।’ ভুয়া এজাহার দেখিয়ে অর্থ বাণিজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা কোনো কোনো নেতাকর্মী করেছেন। তবে এখন সেটা বন্ধ হয়েছে।’ ঘটনার সঙ্গে জাপার সম্পৃক্ততা এলো কিভাবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তদন্তের বিষয়। তবে আমার মনে হয় না জাপার কেউ এসব ঘটনায় জড়িত ছিলেন।’
৩ এপ্রিলের ঘটনার সময়ে রয়েল রিসোর্টে উপস্থিত থাকা সোনারগাঁও উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সোহাগ রনি ইত্তেফাককে বলেন, ‘মামুনুল হককে আটকের দুই ঘণ্টার মাথায় আমার বাড়িতে ভাংচুর করা হয়। এ ঘটনায় আমার বাবা হাজী শাহ জামাল তোতা বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন।’ চার ঘণ্টা সময় পেয়েও আওয়ামী লীগের লোকজন কেন সংগঠিত হতে পারেনি, এবিষয়ে সোহাগ বলেন, ‘এখানে আমাদের দলের ভেতরে অনেক গ্রুপিং। তাছাড়া পরপর দুইবার স্থানীয় এমপি (লিয়াকত হোসেন খোকা) জাপার। আমরা নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও গ্রুপিংয়ের কারণেই সংগঠিত হতে পারিনি। তাছাড়া হেফাজতের লোকজন ফেসবুকে লাইভে নানা বক্তব্য রেখে কর্মীদের দ্রুত সংগঠিত করে হামলা চালায়।’
হামলা এবং পরবর্তীতে মামলার সঙ্গে জাপার নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে সোহাগ বলেন, ‘স্থানীয় এমপি ও জাপার নেতা-কর্মীরা ঘটনাস্থলে না আসার কারণে সম্ভবত তাদেরকে এখন দোষারোপ করা হচ্ছে। তবে আমি এসবের মধ্যে নেই।’ ভুয়া এজাহারের বিষয়ে সোহাগ রনি বলেন, ‘বিষয়টি আমিও শুনেছি।’
সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের (সোনারগাঁও) এমপি লিয়াকত হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, ‘মামুনুল হককে আটকের ঘটনা যখন ঘটে তখন আমি অন্য এলাকায় ছিলাম। এমপি হিসেবে প্রশাসনের সকল স্তরে কথা বলে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে সব ধরনের পরামর্শ দিয়েছি। আর প্রকৃত ঘটনা যেন রাজনৈতিক কারণে কেউ ভিন্নদিকে প্রবাহিত করতে না পারে, সেজন্য আমি তাত্ক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে যাইনি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঘটনার সঙ্গে জাপার নেতা-কর্মীদের জড়ানো সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’