বিশেষ প্রতিবেদন, মাজহারুল ইসলাম রোকন:
দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পেড়িয়ে গেল আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায়। ক্ষমতাসীন দলের একটি পক্ষ যেমন ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে ফুলে ফেপে মোটাতাজা হয়ে ওঠছে, আবার আরেকটি পক্ষের যেনো অনেক আশা আকাঙ্খার স্বপ্ন তাদের ধুলিসাৎ। মোটাতাজা হওয়াদের বেশির ভাগ সুবিধাবাদী কিংবা ভিন্ন দল থেকে আসা হাইব্রিড কাউয়া প্রজাতির। তবুও তাদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে গুটিকয়েকজন ত্যাগী নেতাকর্মীরা ভাগ বসিয়ে মোটাতাজা হওয়ার চেষ্টায়।
কিন্তু আরেকটি পক্ষ যারা বিএনপি-জামাত জোট সরকার আমলে রাজপথে রক্ত-ঘাম জড়িয়েছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তারা যেনো ফুটো বেলুনের মত মিউয়ে যাচ্ছেন দিনকে দিন। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা তারা বারবার করে গেলেও তাদের বেলুন ফুটো করে দিচ্ছেন তাদের দলেরই এক শ্রেণির নেতা, যারা মুলত তেলবাজি চাটুকারিতা আর তোষামোদীদের রাজ্যের রাজা।
নেতাকর্মীরা বলছেন, কঠিন সময়ের ত্যাগী রাজপথের কর্মীরা তেলবাজি চাটুকারিতা তোষামোদী জানেন না, তাই এখন তাদের দলের ক্ষমতার আমলে বিষাদ ভাগ্য জুটেছে তাদের রাজনীতির ললাটে। এমনি বেশ কজন নেতা রয়েছেন নারায়ণগঞ্জের সরকারি দলে, যারা ত্যাগ স্বীকার করেও বঞ্চিত, কারো কারো ক্ষমতার ঝান্ডা নেতৃত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে, কাউকে সুযোগই দেয়া হয়নি, কোনো ত্যাগীর হাতে নৌকা ওঠলে সেটা পেছন থেকে ফুটো করে দেয়া হয়েছে। অনেকে দলীয় পদ পদবীতে থাকলেও ক্ষমতায় ধারালো নেই তাদের পদ পদবীতে। অনেকটা নখবিহীন বাঘের মত।
অনেক ক্ষেত্রে হাইব্রিড কাউয়াদের সামনের চেয়ারে বসতে দিয়ে দলের ত্যাগী রাজপথের কর্মীদের পেছন সারিতে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের ভেতরে চরম ক্ষোভ আর কষ্ট লালায়িত থাকলেও তারা সেটা প্রকাশ করেনা লজ্জায়। কারন তারা সবাইকে বুঝাতে চায় তাদেরও ক্ষমতা আছে। কেউ কেউ নিজেকে শান্তনা দেন তার দল ক্ষমতায় এটাই অনেক প্রাপ্তি। অনেকে বঞ্চিত হলেও প্রতিবাদ করার সাহস কিংবা প্রতিবাদ করার সুযোগটাও পাচ্ছেন না। কেউ কেউ পেয়েছেন বিরোধী দলীয় স্বাদ। কার্যত তাদের ভেতরে কয়লার আগুন মিউয়ে মিউয়ে জ্বলছে বেদনায়।
তাদেরই একজন অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দিপু। তিনি বর্তমানে আওয়ামীলীগের জাতীয় পরিষদের অন্যতম সদস্য। তরুণ বয়সে হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। কিন্তু তিনি জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে বেশ সম্ভাবনাময় ছিলেন। যদিও অদৃশ্য কারনে তার সেই সম্ভাবনা উড়ে গিয়ে পড়লো অ্যাডভোকেট আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহীদ বাদলের ভাগ্যে। একজন স্বচ্ছ এই রাজনৈতিক এখন আগের মত দাপটশালী প্রভাবশালী না থাকলেও তার ললাটে কখনও বিতর্কের ছাপ পড়েনি।
নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ সানাউল্লাহ। এক সময়কার রাজপথের এই নেতা এখণ কোথায় আছে তার হদিস পাওয়াও দায়। ফতুুল্লা থানা আওয়ামীলীগের সম্মেলনে নিজেকে প্রার্থীতা ঘোষণা দিয়ে পরিস্থিতি বুঝে নানা অভিযোগ তুলে তিনি সরে দাঁড়ান।
জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি সিকদার মোহাম্মদ গোলাম রসূল। ফতুল্লার কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের গত নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীকে লড়াই করেন। কিন্তু ওই ইউনিয়নে তৎকালীন বিএনপি নেতা (বর্তমানে বহিস্কৃত) মনিরুল আলম সেন্টুর কাছে পরাজিত হোন। ওই সময়কার বিএনপি নেতা সেন্টুর লোকজন নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে নির্বাচনী প্রচারণায় বাধাও দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেছিলেন নৌকার প্র্রার্থী। ভাবা যায়? আওয়ামীলীগ নেতা আবার নৌকার প্রার্থী অথচ বিএনপি নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নৌকার প্রার্থীর প্রচারণায় বাধা দেয়। শেষ পর্যন্ত নৌকার প্রার্থী পরাজিত হোন।
জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি মিজানুর রহমান বাচ্চু। তার পৈত্রিক ভিটা আড়াইহাজারে হলেও তাকে আড়াইহাজারে কোনো সুযোগই দেয়া হয়নি রাজনীতিতে। উল্টো তার মেয়ে জামাতা যুবলীগ নেতাকে স্থানীয় এমপির পক্ষের মামলায় আসামি হয়ে জেল খাটতে হয়েছে দীর্ঘদিন। একইভাবে জেলা আওয়ামীলীগের আরেক সহ-সভাপতি আরজু রহমান ভুঁইয়া। শীর্ষ পদে থাকলেও ক্ষমতার স্বাদ তাদের ভাগ্যে জুটেনি।
ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগের সাবেক সেক্রেটারি মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ যিনি বর্তমানে জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য। দলের ক্ষমতার আমলে রাজপথে হামলার শিকার হয়েছেন তিনি। এই আমলেও তার রক্ত ঝড়েছে। ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করা ছাড়া তার আর কোনো প্রতিবাদের সুুযোগ দেখা যায়না।
খুরশিদ আলম সাগর। তিনি ছিলেন বন্দর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু জোর করেই তার পদ কেড়ে নিয়ে আবেদ হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি করে দেয়া হয়। পবরর্তীতে নতুন কমিটিতে সাগরের ছায়াও রাখা হয়নি।
সোনারগাঁও উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সেক্রেটারি আব্দুল হাই ভুঁইয়ার মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান মাহফুজুর রহমান কালাম। বিএনপির জোট সরকার আমলে রাজপথে কঠোর ভুমিকা রাখা এই আওয়ামীলীগ নেতাকে কোনঠাসা করা হয়েছে। প্রথম টার্মে কিছুটা ক্ষমতার স্বাদ পেলেও বর্তমানে তার রাজনীতি ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
মহানগর আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম আরাফাত। শহর কেন্দ্রীক রাজনীতিতে তিনি কোনো মেরুতেই নাই। যে কারনে ক্ষমতার স্বাদে নেই এই নেতা। অথচ তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক সময়কার সাংগঠনিক সম্পাদক।
অ্যাডভোকেট আব্দুর রশিদ ভুঁইয়া। আইন পেশায় তার একমাত্র উপার্জন আয়ের উৎস। কিন্তু আড়াইহাজার আওয়ামীলীগের সেক্রেটারি পদে থেকে স্বচ্ছ রাজনীতিতে থাকলেও তার পদটি কেড়ে নেয়া হয়েছে বর্তমান আমলে।
মহানগর আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি রবিউল হোসেন। সিটি কর্পোরেশনের ১৩নং ওয়ার্ড থেকে একাধিকবার কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু তিনি পরাজিত হয়েছেন বারবার। যেখানে পাশ করে যাচ্ছেন বিএনপির কাউন্সিলর। তবুও রবিউল হোসেনের পরাজয় বহন করা হচ্ছে বারবার।
জেলা যুবলীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক শাহ ফয়েজউল্লাহ ফয়েজ। তিনিও ওই ওয়ার্ডে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু এছাড়াও এক সময় তার রাজনৈতিক যে সক্রিয়তা দেখা গিয়েছিল সেটা আর দেখা যায়না।
সাহাবুদ্দীন সাবু। সনমান্দি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকার পরেও রানিং চেয়ারম্যান সাবুকে নৌকা প্রতীক দেয়া হয়নি। নির্বাচন করলেও রোষানলে পড়তে হয়েছিল তাকে। অথচ বিএনপি জামাত জোট সরকার আমলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আন্দোলনে রাজপথ কাপিয়েছিলেন সাবু।
বন্দর উপজেলা যুবলীগের সেক্রেটারি খন্দকার হাতেম ও ফতুল্লা থানা যুবলীগের সেক্রেটারি ফাইজুল ইসলামের সক্রিয়তা নেই রাজনীতিতে। ক্ষমতার স্বাদের রাজনীতিতেও তাদের দেখা যাচ্ছেনা।
শম্ভুুপুরা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা পেয়েও পরাজিত হয়েছেন অ্যাডভোকেট নূর জাহান। যিনি জেলা মহিলা লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও সোনারগাঁও উপজেলা মহিলা লীগের সভাপতি। বিএনপি জামাত জোট সরকার আমলে যার রাজপথে ব্যাপক ভুমিকা ছিল। কিন্তু নির্বাচনে তিনি রহস্যজনক কারনে পরাজিত হোন।
একইভাবে ২০১১ সালে সোনারগাঁও পৌরসভা নির্বাচনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন উপজেলা যুবলীগের তৎকালীন সভাপতি গাজী মজিবুর রহমান। আওয়ামীলীগের দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করলেও তাকে ষড়যন্ত্রের কারনে পরাজয় বহন করতে হয়। একজন স্বচ্ছ ক্লিন ইমেজের এই নেতার মুল্যায়ন হয়নি আজ অবধি।