“আমার বর্ষা” জীবন থেকে নেওয়া গল্প
মুহুর্তের মধ্যে নৌকাটি পানির নিচে তলিয়ে যায়! নতুন বউ জামাই, সাদা লুঙ্গি পাঞ্জাবী পরা কিছু লোক, মাইক টেপ রেকর্ডার সহ স্রোতের মধ্যে ডুবে গেল। এই তো কিছুক্ষণ আগেও কেরাই নাও থেকে মাইকে ভেসে আসছিল “ঝিনুক মালা” সিনেমার সেই গান, তুমি ডুপ দিওনা জলের কন্যা…. ঝিনুক তাতে পাইবা না,মুক্তা তাতে রইবে না, এই ঝিনুকের মাঝে তুমি মুক্তা খুজে দেখোনা। কিংবা বাপা পিঠারে….. তরে খাইতে গিয়া হা. আমার মুখটা জইলা গেছেরে….। অনেক দূর.. হতে বর্ষার পানির স্রোতের মতই ভেসে আসছিলো সেই গান।বাড়ীর সামনের ঘাটে আমরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেধে সেই করুন দৃশ্য দেখছি। দৃশ্য করুন হলে কি হবে? আমারা কিন্তু বেজায় মজা পাচ্ছিলাম।
মানুষের হৈ হৈ শব্দে মুহূর্তে একটা গম গম শব্দে রুপ নিলো। কিছু ক্ষণ পরই দেখতাম নতুন বৌ সাঁতরিয়ে পাড়ে উঠছে। হয়তো বা কিছু লোক আনকোরা মাঝি কে গ্রাম্য ভাষায় গালাগালি করছে। ছোট খালের পাশ্বে আমাদের গ্রাম থাকার সুবাধে এই ধরনের কান্ডকারখানা শ্রাবন ভাদ্র মাসে প্রায়ই দেখা হতো।
ভাদ্র মাসে গ্রামের কাচা রাস্তা গুলোতে মাছের শুটকির গন্ধে হাটাই দুস্কর হতো। বর্ষায় ছেলেপুলেরা এতো মাছ ধরতো,সেগুলো সব না খেতে পেরে, মানুষজন সমানে শুটকি দিতো।
আর সেই সময় মাছ ধরার কি বৈচিত্র্য ছিলো,তা বলে শেষ করা যায় না।কেউ নালার মধ্যে টানা জাল পাততো, কেউবা খুছি দিয়ে কেউ টেটা,বল্লম নিয়ে সারাদিন টৈ টৈ করে ঘুরে বেড়াতো কাঙ্ক্ষিত মাছের আশায়। পুটি,বৈচা,মেনি,সিং,কাইক্কা,খৈলশা, বাইম তিত পুটি, চাওন্দা আহ্ কত মাছের নাম।কিন্তু মজার বিষয় ছিল যতই মাছ ধরার হিড়িক পরুক না কেনো,আমি কোন কালেই মাছ ধরতে পারতাম না।মাছ হাতে লাগলে কেমন জানি ভয় করতো। এরও একটা কারন আছে।
আমি তখন খুব ছোট আমাদের বাড়ির সামনে এমনি একদিন মানুষ ঝাক বেধে মাছ ধরছিলো। তো, মা সেই দৃশ্য দেখে অনেক উৎসাহে আমাকে বল্লো,- “যা এই চালুনটা দিয়ে দেখ মাছ ধরতে পারোস কি না”?তখন আমি আনন্দে নেচে নেচে বাঁশের ফলা দিয়ে বানানো চালুন নিয়ে আমি নেমে পড়লাম খালে। দু’ একবার খেও দিলাম ,দুএকটা মাছও পেলাম। কিন্তু আসল বিপত্তি দেখা দিলো একটু পরে। যেই একটা কচুরির নিচে চালুন ডুকালাম সাথে কচুরিও পরিস্কার করছিলাম আর অমনি ভেসে উঠলো ইয়া বড় এক সাপ! ওরে বাবা বিদ্যুৎ বেগে মাছ-টাছ রেখে সোজা ডাঙায় চলে আসলাম, আমার সারা সরীর কাটা দিয়ো উঠলো। কখন যে উপরে আসলাম নিজেও বলতে পারবো না। সেই থেকে মাছ ধরার স্বাধ জনমের জন্য শেষ হলো।
বর্ষাকালে আরেকটা মজা হতো আমাদের জন্য, গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে যখন পাট উঠতো,এই পাঠখড়ি শুকানোর জন্য অনেকটা কলসির মত সবার বাড়িতে ছরিয়ে দিতো। আর সেই সময়টাতেই বিভিন্ন রঙের ফড়িং বসতো সেই পাটখড়ির উপর। ফড়িংএর কত নামছিলো, তাল ফড়িং, গোয়াল্ল্যা ফড়িং ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন আর অতো মনে নেই। সোলার মাথায় কাফিলার কষ মেখে ছোটরা ফড়িং ধরতাম (কাফিলা একধরনের বৃক্ষ যা প্রায় বড়িতেই থাকতো)। আবার সেই ফড়িংয়ের লেজে সুতা বেধে ছেরে দিতাম। ফড়িং সেই সুতা নিয়ে যখন উড়ে চলতো সেই দৃশ্য দারুণ ভাবে আমরা উপভোগ করতাম।
বর্ষায় চলাচলের জন্য তখন নৌকার বিকল্প কিছু ছিল না। এখনকার মতো গ্রামে অতো রাস্তা- ঘাট ছিলোনা। যাতায়াতের জন্য কেরাই নৌক থাকতো প্রধান বাহন।কেউ যদি শহরে বা দূরে কোথায়ও যেতো ফিরতে ফিরতে গভীর রাত হতো। আর রাতে যখন নৌকা বাড়ির ঘাটে ভিরতো লগি বৈঠার শব্দে মনের ভিতর অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি হতো। কিংবা গভীর রাতে শুনতে পেতাম হাক ডাক। “ঐ অলেক্কা পাড় কররে……….”, কেই ডাকতো, “ঐ ধনা……….আবার ওপার হতে গলার আওয়াজ ভেসে আসতো,” আহি ও.. ও………..”।
বরাবরই বর্ষা আমার প্রিয় ঋতুগুলোর মধ্যে একটি, এই সময়টাতে বাজারে ইলিশের খুব ধুম পরতো। এখনকার মত এতো ফরমালিন আর বরফের ব্যবহার তখন ছিলোনা। ফলে বাজারে দেখতাম প্রচুর ইলিশ উঠতো, সাথে গায়ে নরম ইলিশও থাকতো। তখন মানুষজন দেদারসে ইলিশ কিনতো। আহ্ ইলিশের গন্ধেই পেট ভরে যেতো, মৌ মৌ করতো পাড়া জুড়ে।
আমাদের পরিবারে একটা মজার কান্ডু হতো, যখনই বৃষ্টি নামতো মাকে দেখতাম ঘরের ড্রাম হতে কলাই, মটর,ডাল ভেজে দিতো, আমরা ভাই বোনেরা মিলে কত মজা করে খেতাম। এখন এগুলো বইয়ের পাতার গল্প।
বর্ষায় বন্যা ছিলো ছোটদের জন্য আলাদা অনুভূতি, আমার মনে আছে ৮৮ সালের বন্যায় আমি তখন থ্রি, ফোরে পড়ি,আমাদের দোতলার ছাদে রান্না হতো অনেকট বনভোজনের মতো অবস্থা সবাই একসাথে। কিন্তু খাবারের জোগানের ব্যপারে ছোটদের মাথা ব্যথা থাকতোনা, তাই অনেক আনন্দের সাথেই বন্যাগুলো পার করেছি। এ ঘর থেকে ওঘরে যাওয়ার জন্য বাঁশের সাঁকো থাকতো, আবার সেই সাঁকোতে গোসলও সারা হতো।
তবে মন খারাপ হতো বর্ষার শেষের দিনগুলোতে। আমি নিজে দেখেছি যারা নৌকা চালাতো তাদের হাতে ফোস্কা পড়ে যেতো, কত কষ্ট করে তারা সংসারের ঘানি টানতো এখন ভাবলে গা শিহরে উঠে।
এমনই একদিন শানবাঁধানো ঘাটে আমার সাঁতার শিখার হাতে খড়ি হয়েছিলো।মনে পড়ে সাতার শিখার জন্য আমার এক বোন ছিলো,নাম জোবেদা মারা গেছেন,ওনি আমাকে ঠিল মেরে অনেকটা দূর ফেলে দিতো আর আমি আধাজল খেয়ে খেয়ে ফিরে আসতাম,এভাবেই চলতো প্রথম সাঁতারের দিন গুলো।
যখন একটু বড় হলাম স্কুল, কলেজে পদার্পন করলাম তখন আবার বর্ষার নতুন রুপ এসে ধরা দিলো।আমরা ছেলেরা দল বেধে নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পরতাম পাট ক্ষেতার সারিতে সারিতে। নৌকা চলতো গলা ছেরে গান শুরু হতো। আবার কিছুক্ষণ পরই হুড়োহুড়ি করে পানিতে মারতাম ঝাপ।সাঁতরানো নৌকা ডুবানো দুরন্তপনা সেই দিনগুলোতে থাকতো নিয়মিত কার্যবিবরনীর একটি।
এখনো বর্ষা আসে এখনো সারাদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়,নেই সেই খোলা জলে ভরা বিল,নেই সেই কেরাই নাও, নেই মাঝিদের হাক-ডাক। বিভিন্ন রঙের নৌকা বাইচ এখন আর চোখে পড়েনা। বর্ষা যেনো বৃষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। শহরের উচু দালানগুলোতে ইলিশের স্বাদের মধ্যে বর্ষা খুজে পায় এখন নগরবাসী। টিকে থাকুক বর্ষা, টিকে থাকুক আমার বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র।
লেখক: খন্দকার পনির