সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি’র আওতাধীন পাঁচটি থানায় ১০টি ইউনিট কমিটি গঠনের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে রাজনীতি থেকে প্রবীণদের বিদায় ঘন্টা বেজে গেল। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন দিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার ও মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামালকে বহিষ্কারের মাধ্যমে সেই বিষয়টি আরো বেশি ত্বরান্বিত হলো। তবে প্রবীনদের যখন বিদায় বেলা তখন বর্তমান প্রজন্মের নেতাকর্মীদের মাঝে আলোচনায় উঠে এসেছে তারা বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে দল থেকে কি নিয়েছেন এবং দলকে কি দিয়ে গিয়েছেন?
যদিও কেউ কেউ দল থেকে অনেক কিছু নিয়ে দলকে কিছুই দেননি, আবার কেউ কেউ খালি হাতে ফিরে গেছেন দলের জন্য অনেক কিছু করেও, যারা নিজের পকেটে কিছুই ভরতে পারেননি। সান নারায়ণগঞ্জকে অনেকেই বলেছেন-এমন নেতার সংখ্যাও কম নয়।এমন পরিস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জ জেলার প্রবীণ ও শীর্ষ নেতাদের রাজনীতি থেকে বিদায় ঘন্টা বেজে গেছে।তাদের মধ্যে হয়তোবা দু-একজন রাজনীতিতে কয়েকটি বছর টিকে থাকতেও পারেন। তবে বাকিদের রাজনীতিতে ফেরা প্রায় অনিশ্চিত হয়ে গেছে।
স্থানীয়দের সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে মাত্র কয়েক সপ্তাহের জন্য বিএনপি থেকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন শিল্পপতি মোঃ আলী। তিনি অনেক আগেই বিএনপির রাজনীতি ছেড়েছেন। কয়েক বছর যাবৎ তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন নাকি জাতীয় পার্টির রাজনীতি করেন সেটাও স্পষ্ট না করলেও তিনি যে বিএনপি করেন না সেটা অনেক আগেই স্পষ্ট করেছেন। তিনি এক সময় বিএনপির রাজনীতি করতেন সেই চিহ্নও তার বক্তব্যে নাই। এক এগারোর সময় তিনি এফবিসিসিআইয়ের ভারপ্রাপ্ত সভাপতিও ছিলেন।
অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার ১৯৯৮ সালের দিকে বিএনপির রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। রাজনীতিতে এসেই মহানগর বিএনপি’র আহবায়ক হয়ে যান। তিনি অনেকটা বড় কপাল গুণেই শীর্ষ পর্যায়ে এসেছেন। এরপরে রাজনীতিতে এসে অবস্থান তৈরি করে নেন। যার ফলশ্রুতিতে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সুদৃষ্টি থাকায় ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসায় তৈমুর আলমকে প্রথমে এডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেল করা হয়। পরবর্তীতে তাকে বিআরটিসি চেয়ারম্যান বানানো হয়। ২০০৬ সালেও তাকে নমিনেশন দেওয়া হয় রূপগঞ্জ আসন থেকে। কিন্তু ২০০৬ সালে তিনি জেলে গেলে ২০০৮ সালে তিনি এ নির্বাচন করতে পারেননি। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি তাকে সমর্থন দিলেও নির্বাচনের ৭ ঘণ্টা আগে তাকে নিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়। এবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের বাহিরে গিয়ে নির্বাচন করায় জেলা বিএনপির আহ্বায়ক থেকে, কেন্দ্রীয় আইনজীবী ফোরামের সদস্য থেকে, খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। নির্বাচনের পরে তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়।
অ্যাডভোকেট আবুল কালাম বিএনপি’র সাবেক সংসদ সদস্য। তিনি বর্তমানে মহানগর বিএনপি’র সভাপতি পদে রয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে একটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেও তিনি পরাজিত হয়ে তার মনোনয় বাজেয়াপ্ত হয়েছিল, সেই পরাজিত কাউন্সিলর প্রার্থী বিএনপি’র নমিনেশনে ৪বার এমপি নির্বাচিত হন। এরপরেও তিনি এক এগারোর সময় জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে সংস্কারবাদীদের সঙ্গে যোগ দেন আবুল কালাম। তার বর্তমান শারীরিক অবস্থা অনেকটাই নাজুক। সান নারায়ণগঞ্জ জানতে পেরেছে, কালামের স্থলে তার ছেলে আবুল কাউসার আশাকেই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে। আবুল কালামের রাজনীতির বিদায় বেলা।
আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এসএম আকরাম। তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক। ২০১১ সালের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থনে মেয়র পদে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সমর্থন পাননি। ওই নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ডাক্তার সেলিনা হায়াত আইভীর পক্ষে কাজ করেন। নির্বাচনের পরদিন সাংবাদিক সম্মেলন করে জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক পথ সহ আওয়ামী লীগ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। এর বছরখানেক পর তিনি মাহমুদুর রহমান মান্নার দল নাগরিক ঐক্যের উপদেষ্টা পরিষদের তিনি দায়িত্ব নেন। ২০১৪ সালে বিএনপির সঙ্গে ঐক্যজোট করলে তিনি ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে নির্বাচন করেন। এবার তারও রাজনীতিতে বিদায় বেলা।
মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন হরেক রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন। করেছিলেন জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ। এখন তিনি বিএনপি’র নেতা কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। তিনি জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে থাকাকালীন সময়ে তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধির ছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের মাত্র ২১ দিন পূর্বে আওয়ামী লীগের কৃষকলীগের সহ-সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করে বিএনপিতে যোগদান করেই ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের শামীম ওসমানকে হারিয়ে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। এমপি নির্বাচিত হয়ে গিয়াসউদ্দিন নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করেন। বর্তমান রাজনীতিতে তারও বিদায় ঘন্টা বেজে গেল। তৈমুর আলম খন্দকারকে সরিয়ে দেওয়ার কারনে কেউ কেউ মনে করছেন জেলা বিএনপি’র আহবায়ক কিংবা সভাপতি পদে গিয়াস উদ্দিনের সম্ভাবনা জেগেছে। একইসঙ্গে শিল্পপতি শাহ আলম রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার কারনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন গিয়াস উদ্দিনের জন্য অটোমেটিক বরাদ্দ হয়ে গেছে। ফলে গিয়াসউদ্দিনের শারীরিক অবস্থার উপর এবং বয়সের উপর নির্ভর করবে তিনি আর কতদিন রাজনীতিতে থাকতে পারবেন। তার জন্য অনেকটা মাঠখোলা হয়ে গেছে।
একটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি পদ থেকে বিএনপিতে যোগদান করেছিলেন বিএনপি’র সাবেক সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খান আঙ্গুর। মূলত তার প্রয়াত ভাই বদরুজ্জামান খান খসরুর হাত ধরেই বিএনপিতে যোগদান করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে আঙ্গুর একাধিকবার বিএনপির এমপি নির্বাচিত হন। এরপরেও তিনি এক এগারোর সময় জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে সংস্কারবাদীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। আড়াইহাজারের রাজনীতিতে আঙ্গুরের সেই আগের অবস্থান নেই। রাজনীতি থেকে এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে আঙ্গুর।
অধ্যাপক রেজাউল করিম একটি অতি সাধারণ পরিবারের সন্তান ছিলেন। সেখান থেকে বিএনপির রাজনীতির মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ) আসনে তিনি একাধিকবার এমপি নির্বাচিত হন। একই সঙ্গে তাকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীও করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি ছিলেন জেলা বিএনপি’র সভাপতি পদে। এক এগারোর সময় খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। একসময় বিরাট দাপটশালী নেতা সোনারগাঁয়ে এখন রাজনীতিতে নেই। তার শারীরিক অবস্থাও এখন আর সেই অবস্থানে নেই। ফলে রেজাউল করিমের রাজনীতি এখন বিদায়।
কল্যাণ পার্টির কোষাধ্যক্ষ পদ থেকে পদত্যাগ করে বিএনপির রাজনীতিতে এসেছিলেন শিল্পপতি মোঃ শাহ আলম। অনেকটা এমপি হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই এই শিল্পপতি বিএনপির রাজনীতিতে আসেন। ২০০৬ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে নির্বাচন করেছিলেন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে। ওই নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীকের প্রার্থী চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সম্প্রতি তিনি বিএনপির সকল পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।
শিল্পপতি কাজী মনিরুজ্জামান মনির ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি’র সভাপতি। নানা ব্যর্থতার কারণে তাকে সেই পদ থেকে সরিয়ে আবারো তৈমুর আলম খন্দকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। এর আগে তৈমুর আলম খন্দকারের সঙ্গে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কাজী মনির। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেছিলেন কাজী মনির। বিজয়ী হতে পারেননি। জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্বে থাকলেও ওই সময় তিনি তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। একসময় বাম দলের রাজনীতি জড়িত ছিলেন কাজী মনির। বর্তমানে বিএনপি থেকে একেবারে নিষ্ক্রিয় কাজী মনির। ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের একসময়কার নিয়ন্ত্রকও ছিলেন কাজী মনিরুজ্জামান। এবার তারও বিএনপির রাজনীতিতে বিদায় বেলা।
আনোয়ার হোসেন খান ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। জিয়াউর রহমানের জাগো দল থেকে বিএনপির রাজনীতিতে পদার্পণ আনোয়ার হোসেন খানের। কেন্দ্রীয় যুবদলের রাজনীতিতে আসা আনোয়ার খান অনেকটা তিনি খালি হাতে ফিরে গেলেন রাজনীতির বিদায় বেলায়।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে নারায়ণগঞ্জ শহরের রাজনীতিতে ত্রাস গাব্বার সিং খ্যাত আব্দুল মজিদ খানও রাজনীতির বিদায় বেলায়। নারায়ণগঞ্জ নগরীতে ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতিতে বিএনপির অন্যতম ছিলেন এই মসজিদ খন্দকার। যার অন্যতম দুই ভাইয়ের মধ্যে রয়েছেন বর্তমানে হাসান আহমেদ। সেই রাজনীতি ছেড়ে স্বচ্ছ রাজনীতিতে ফিরলেও মসজিদ খন্দকারের বয়সের কারণে বিএনপি’র রাজনীতিতে পুরোদমে নাই। একইভাবে পদবঞ্চিত হয়ে হাসান আহমেদ রয়েছেন দূরে। তার সহধর্মিণী আফসানা আফরোজা বিভা হাসান। তিনি সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ছিলেন। এবারও তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। এখন বিভার ওপর নির্ভর করেই মজিদ পরিবার রাজনীতিকে রয়েছে টিকে।
যুবদলের রাজনীতিতে দিয়ে বিএনপির রাজনীতি শুরু এটিএম কামালের। মাঝে প্রবাস জীবন কাটিয়েছেন, আবারো ফিরেছেন রাজনীতির মাঠে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে তিনি বিকল্প ধারা বাংলাদেশ দলে যোগদান করেন। অভিযোগ রয়েছে ওই সময় তিনি খালেদা জিয়া এবং তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে নানা বক্তব্য দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আবারও তিনি বিএনপিতে ফিরেন। ছিলেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। এর আগে তিনি শহর কমিটিতেও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এবার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তিনি দলের বাইরে গিয়ে তৈমুরের পক্ষে নির্বাচন করায় দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার রাজনীতি ফিরে আসাটা খুব কঠিন মনে হচ্ছে। যদিও সিটি নির্বাচনের পূর্বে তিনি আমেরিকায় প্রবাস জীবন কাটাচ্ছিলেন। আবারো হয়তো ফিরে যাবেন আমেরিকায়।
অধ্যাপক খন্দকার মনিরুল ইসলাম ছিলেন ফতুল্লা থানা বিএনপি’র সভাপতি। অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার যখন জেলা বিএনপি’র সভাপতি ছিলেন তখন খন্দকার মনিরের মতো রাজনৈতিক নেতাকে মাইনাস করে শিল্পপতি শাহ আলমের হাতে ফতুল্লা থানা বিএনপির কর্তৃত্ব তুলে দিয়েছিলেন। তারপরেও খন্দকার মনিরুল ইসলাম ছাড়েননি তৈমুরের সঙ্গ। খন্দকার মনিরুল ইসলামের সেই আগের জৌলুস অবস্থান ফতুল্লায় নেই। ফতুল্লা বিএনপির নতুন কমিটি হয়েছে জাহিদ হাসান রোজেল ও শহিদুল ইসলাম টিটুর মাধ্যমে।