সোনারগাঁয়ে কৃষকের ফসলি জমি থেকে মাটি চুরির মহোৎসব

ডেস্ক রিপোর্ট

রাতের আঁধারে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার জামপুর ইউনিয়নের পাকুন্দা ও সিংলাব গ্রামের কৃষকের তিন ফসলি জমি পুকুর বানিয়ে ফেলছে মাটি সন্ত্রাসীরা। এই মাটি চলে যাচ্ছে স্থানীয় বিভিন্ন ইটভাটায়। এতে এ এলাকার কয়েকশ একর কৃষিজমি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। কৃষকরা প্রতিবাদ করলে বা বাধা দিতে গেলে তাদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে গিয়েও তারা কোনো প্রতিকার পান না।

এই মাটি সন্ত্রাসের পেছনে রয়েছেন উপজেলা জাতীয় পার্টির নেতা আবুল বাশার বাবু, জামপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা হামীম শিকদার শিপুল। ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর শিপলুর বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ঘটনায় মামলা হয়। তার পরও তিনি আত্মগোপনে থেকে স্থানীয় কিছু বিএনপি নেতার সঙ্গে আঁতাত করে তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। জোর করে কৃষকের জমির মাটি কাটা নিয়ন্ত্রণ করছেন শিপলুর চাচাতো ভাই সালাম শিকদার ও বেয়াই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কাজী রাসেল।

গত কয়েকদিন সরেজমিন সিংলাব গ্রামে দেখা গেছে, মাটি কেটে কৃষিজমিতে পুকুর বানিয়ে ফেলা হয়েছে। ট্রাক ও নছিমনে করে মাটি বিভিন্ন ইটভাটায় নেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় কৃষক শাহিন মিয়া বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সময় যারা নির্বিচারে জমির সব মাটি কেটে নিয়েছে, তারাই আবার এখন রাতের অন্ধকারে আমাদের চাষের জমির মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক জমি থেকে ১০ থেকে ১৫ ফুট গভীর করে মাটি কাটা হচ্ছে। এর প্রতিবাদ করলে কৃষকদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে সন্ত্রাসীরা।’

এসব জমির মাটি প্রতি বিঘা ইটভাটায় দেড় থেকে ২ লাখ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানান স্থানীয়রা। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট দপ্তরে মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিয়েই আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতারা বছরের পর বছর মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। এসব বিষয় জেনেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কয়েকদিন ধরে বিএনপি নেতাদের ট্যাগ ব্যবহার করে আগের মতো মাটি কাটার উৎসব চলছে। ফলে কৃষিজমি বিলীন হয়ে পরিণত হচ্ছে জলাশয়ে।

পাকুন্দা গ্রামের কৃষক রমজান মিয়া বলেন, ‘কয়েক বছর ধরেই এলাকার প্রভাবশালী নেতারা রাতের আঁধারে কৃষিজমির মাটি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন। ধানের মৌসুমে জমির মাটি কেটে নিয়ে গর্ত করে পুকুর বানিয়ে দিচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন এসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় আমরাও আতঙ্কে আছি। তাই বর্তমান সরকারের কাছে আমরা এর প্রতিকার ও মাটি লুটের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।’

অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় জাতীয় পার্টির নেতা আবুল বাশার বাবুর সঙ্গে। তিনি নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে পুরো দায় চাপান আওয়ামী লীগ নেতা ও জামপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হামীম শিকদার শিপলুর বিরুদ্ধে। আবুল বাশার বলেন, ‘শিপলুর নেতৃত্বেই তার বেয়াই কাজী রাসেল ও তার চাচাতো ভাই ছাত্র আন্দোলনের একাধিক হত্যা মামলার আসামি সালাম শিকদারের নেতৃত্বে কৃষকের মাটি কাটা হচ্ছে।’ আবুল বাশার আরও বলেন, ‘আমি বিএনপির রাজনীতি করি। আমি এ ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত নই।’

অভিযুক্ত কাজী রাসেলও মাটি কাটার সঙ্গে জড়িত নন দাবি করে দোষ দিয়েছেন হামীম শিকদার শিপলুর চাচাতো ভাই সালাম শিকদারের। এ বিষয়ে অভিযুক্ত সালাম শিকদারের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি। আর সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হামীম শিকদার শিপলু পলাতক থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জের সহকারী পরিচালক এ এইচ এম রাশেদ বলেন, ‘মাটি কাটার বিষয়টি আমাদের ডিসি স্যার দেখেন। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হলে আমাদের জেলা প্রশাসকের অনুমতি লাগবে। তবে আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখব।’

উপজেলা কাঁচপুর সার্কেল সহকারী কমিশনার (ভূমি) শেগুফতা মেহনাজ বলেন, ‘এখানে নতুন যোগদান করেছি। গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে বিষয়টি অবগত হয়েছি। জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা রহমান বলেন, ‘সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আব্দুল বারী বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে মাটি কাটছে কি না, আমার জানা নেই। তবে গত সোমবার গোপন সূত্রে খবর পেয়ে আমাদের পুলিশ গিয়ে মাটি কাটার কাজ বন্ধ করে দিয়েছে এবং সেখান থেকে মাটি কাটায় ব্যবহৃত একটি এক্সক্যাভেটর জব্দ করে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। কৃষকরা লিখিতভাবে জানালে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’