সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:
এক সময় শিক্ষককে পিতৃতুল্য বলে মনে করা হতো। প্রাচীন কাল থেকেই শিক্ষকদের মর্যাদায় নানা গল্প, নাটক, কবিতা শুনে আসছি। কিন্তু সেই শিক্ষকদের মধ্যে আজকাল অনেকেই সেই সম্মান ভুলে ধর্ষকের ভূমিকায় নেমেছে। তাদের কাছে যৌন হয়রানীর শিকার হচ্ছেন ছাত্রীরা। হতাশায় ফেলে দিচ্ছে পুরো জাতিকে। ভেঙ্গে দিচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা। এমন ঘটনায় সারাদেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলার আনাচে কানাচে ঘটেই চলেছে। লোক লজ্জায় ভয়ে আড়াল হয়ে যাচ্ছে এমন নানা ঘটনা। এসব ঘটনায় দুএকটি জানা যায় যখন ঘটনাক্রমে তা প্রকাশ হয়। এমন ঘটনার শীর্ষে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১১। তাদের মধ্যে একজন মোবাইলে আপত্তিকর ছবি তুলে ২০ জনের বেশি ছাত্রীকে ব্ল্যাকমেইল করে ধর্ষণ করেছে। আর অন্যজন অপরাধে সহযোগিতা করেছে। সম্প্রতি সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি কান্দাপাড়ার ‘অক্সফোর্ড হাইস্কুল’ নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মাদারিপুর শিলপাড়া এলাকার মৃত নিয়াজুল ইসলামের ছেলে আরিফুল ইসলাম ও ফরিদপুর বটচর এলাকার মৃত সৈয়দ বদিন শেখের ছেলে রফিকুল ইসলাম জুলফিকার।
সূত্রে জানা যায়, সিদ্ধিরগঞ্জের অক্সফোর্ড হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক আরিফুল ইসলাম আট বছর ধরে স্কুলটিতে অংক ও ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষকতা করে আসছে। ছাত্রীদের কোচিংয়ের জন্য তার ভাড়া বাসা ছাড়াও স্কুলের পাশে বুকস গার্ডেন এলাকায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। সেখানেই আরিফুল ইসলাম অসংখ্য ছাত্রীকে প্রতারণার মাধ্যমে আপত্তিকর ছবি তুলে ধর্ষণ করে। আর স্কুলের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম জুলফিকার শিক্ষক আরিফুল ইসলামকে সহযোগিতা করছিল। এসব জানতে পেরে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী স্কুলে হামলা চালিয়ে আরিফুল ইসলাম ও রফিকুল ইসলাম জুলফিকারকে গণপিটুনি দেয়।
খবর পেয়ে র্যাব আরিফুুল ইসলাম ও সহযোগী হিসেবে প্রধান শিক্ষককে আটক করে। পরে র্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ২০ জনের বেশি ছাত্রীকে ব্ল্যাকমেইল করে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে আরিফুল ইসলাম ও তার সহযোগী।
স্থানীয়রা জানায়, ২০০৩ সালে কান্দাপাড়া এলাকায় বাড়ি ভাড়া করে ছোট্ট একটি কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠা করেন রফিকুল ইসলাম জুলুফিকার। পরবর্তীতে স্কুলের লাভের টাকা দিয়ে বর্তমান স্কুলের জমিসহ চারতলা ভবনটি কেনেন তিনি। আর সেখানে শিশু শ্রেণি থেকে ৯ম শ্রেণির পর্যন্ত পড়ানো হয়। আট বছর আগে এ স্কুলে অংক ও ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান আরিফুল ইসলাম।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক অভিভাবক জানান, তার মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় শিক্ষকের যৌন হয়রানির শিকার হয়। মেয়ে এখন ৯ম শ্রেণিতে পড়ছে। এখনও লম্পট শিক্ষক থেকে রক্ষা পায়নি। কিন্তু ঘটনার এত বছর পেরিয়ে গেলেও আমার মেয়ে বিষয়টি চেপে রাখায় কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারিনি। দুদিন আগে ব্যাপারটি জানতে পেরে এলাকার যুবকদের বলেছি। এলাকাবাসী জানতে চাইলে তখন আরিফু ইসলাম তার মোবাইলে থাকা আপত্তিকর ছবিগুলো মুছে ফেলে। তবে স্থানীয়দের মধ্য থেকে তার মোবাইল জব্দ করে এলাকার একটি মোবাইল দোকানে সফটওয়্যারের মাধ্যমে ছবিগুলো উদ্ধার করে। প্রমান পেয়ে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী দুই শিক্ষককে গণপিটুনি দেয়।
এ ঘটনার রেষ না কাটতেই নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় মাহমুদপুর পাকার মাথা এলাকায় ১২ ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে কথিত মাওলানা আল আমিন নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১১। ৪ জুলাই বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ‘বায়তুল হুদা মাদ্রাসা’ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন এসব ঘটনায় তরিৎ আইনি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
ঘটনা নারায়ণগঞ্জেই শেষ নয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিনিয়ত চোখের আড়ালে কিংবা প্রকাশ্যে ঘটছে এসব ভয়ানক কান্ড। একইভাবে সম্প্রতি হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে চৌধুরীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করায় ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
জানা যায়, ওই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রী প্রতিদিনের ন্যায় মঙ্গলবার অভিযুক্ত শিক্ষক মোজাম্মিল হোসন খানের কাছে প্রাইভেট পড়তে যায়। এ সময় শিক্ষক মোজাম্মিল হোসেন খান তাকে একা পেয়ে তার স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দেয়াসহ বিভিন্ন ধরণের যৌন হয়রানি করেন। ঘটনা জেনে ছাত্রীর বাবা উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দেন।
অপর ঘটনায় জামালপুরের বকশীগঞ্জে দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে সেখানকার এক লম্পট শিক্ষকের বিরুদ্ধে। ঘটনাটি ঘটেছে ১৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় ধানুয়া কামালপুর কো-অপারেটিভ উচ্চ বিদ্যালয়ে।
জানা যায়, ওই বিদ্যালয়ের ইংরেজী শিক্ষক হিসেবে দুই বছর আগে যোগদান করেন শ্রীবরদী উপজেলার আরিফুর রহমান। আরিফুর রহমান যোগদানের পর থেকেই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানোর নামে ছাত্রীর মোবাইল ফোনে বিভিন্ন ধরণের অশালীন ভাষা ব্যবহার করে এসএমএস দেয়। এছাড়াও জোরপূর্বক যৌন হয়রানী করে। পরে অভিভাবকের অভিযোগের ভিত্তিতে বকশীগঞ্জ থানার ওসি একেএম মাহবুব আলম, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন ওই লম্পট শিক্ষক আরিফুর রহমানকে গ্রেপ্তার করেন।
আরো এক ঘটনায় কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের রামপ্রসাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খায়রুজ্জামান বিরুদ্ধে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করার অভিযোগ উঠেছে। গত রবিবার পহেলা বৈশাখ শেখ হাসিনা ধরলা সেতুর পশ্চিম ওয়াপদাপাড়ে মধ্য যতিন্দ্র নারায়ণ এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ছাত্রীর বাবা বিচার চেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
এভাবে আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে অনিরাপদ হয়ে পড়ছেন ছাত্রীরা। এতে যেমন অভিভাবকের চিন্তা বাড়ছে তেমনি বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। ভুক্তভোগী ও সচেতন মহলের দাবী এমন চিহ্নিত লম্পটদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির । পাশাপাশি বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি, উপজেলা শিক্ষা প্রশাসন, অভিভাবকসহ সমাজসেবীদের নজরদারী বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
লেখক: মাহবুব আলম প্রিয়
সাংবাদিক ও কলামিষ্ট