অপরাধ দমিয়ে রাখা নয়, চাই মূল উৎপাটন

সম্পাদকীয়:

নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বর্তমান পরিস্থিতিতে সত্য লিখতে বেশ সাহসই পাই। লিখে বুক ফুঁলিয়ে প্রভাবশালীদের সামনে দিয়ে ঘুরলেও তারা কিছু বলছেনা। কিন্তু যখন ভবিষৎের কথা চিন্তা করি তখনি বুকটা কেঁপে ওঠে। ভয় আতংকে ওঠি। সে কারনে কিছু লিখতে চাইনা। তবুও মুখ বুঝে থাকতে পারিনা। ওইযে কলম হাতে চুলকানি দেয়। তবে মনের ভিতরে অনেক লেখা জমে থাকে। অনেক সত্য বলতে পারছি, লিখতে পারছি, বেশ ভালও লাগছে। নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিক সমাজও বেশ জোড়ালো অবস্থানে সত্যের পক্ষে। তবে খুব বেশি যে সত্য বলতে লিখতে পারছেন তাও কিন্তু নয়। অনেকেই আবার ভবিষৎের কথা চিন্তাও করেন। আমিও করি। তবে আজকের লেখাটা অনেকটা চুলকানির মতই। তাই ভবিষৎের চিন্তাও কম।

যাহোক এদিকে ঢাকা বিভাগীয় রেঞ্জে ৫ম বারের মত শ্রেষ্ঠ এসপি নির্বাচিত হয়েছেন নারায়ণগঞ্জে এসপি মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ যিনি প্রধানমন্ত্রী পদক ও রাষ্ট্রপতি পদকে ভূষিত হয়েছেন আগেই। তাকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই। কেউ মনে করবেন না তেল মারছি। তেল মারার কোন প্রয়োজনীয়তা তার কাছে আমার নাই। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোন পরিচয়ও নাই, পেশাগত কারনে তার আহুত সংবাদ সম্মেলনে দেখা সাক্ষাত ছাড়া। তাই যে যাই মন্তব্য করেন তেল মারতে বসিনি। কারো পক্ষেও নয় বিপক্ষেও নয়।

নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ যোগদানের পর নারায়ণগঞ্জে এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজারের বেশি মাদক বিক্রেতা ও মাদকসেবীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যদিও মাদকের রাঘববোয়ালদের এখনও ধরতে পারেননি বলে খোদ এসপি নিজেই স্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন- রাঘববোয়ালদের তথ্য পুলিশ বাহিনীর কাছে রয়েছে। তবে তিনি রাঘববোয়ালদের নাম প্রকাশ করেননি। তাহলে ধরে নিতে পারি তিনি রাঘববোয়ালদের ধরবেন! সেটা সময়ের অপেক্ষা।

ভনিতা না করে আরেকটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আসি মূল প্রসঙ্গে। তবে আবারো বলে রাখি আমার আজকের লেখাটি কারো পক্ষে বা বিপক্ষে নয়। তবে অবশ্যই মাদকের বিরুদ্ধে বরাবরেই মত যেমন ছিলাম তেমনি আছি। সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ ভূমিদস্যূ মাদকের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান সব সময়। আজকের লেখাটির শিরোনাম দেখে কেউ কেউ মনে করতে পারেন এসপির তোষামোদী করছি বা আরো নোংরা ভাষায় কিছু মন্তব্যও করতে পারেন। কেউ কেউ ভাবতে পারেন যাদের সঙ্গে এসপির সু-সম্পর্ক নাই, তাদের বিরুদ্ধে লিখছি বিষয়টি তেমনও নয়।

নারায়ণগঞ্জে এসপি হারুন অর রশীদ যোগদানের পর তার ভুমিকা নিঃসন্দেহে প্রসশংনীয়। নারায়ণগঞ্জের বেশকজন আলোচিত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ ও গ্রেপ্তার করেছেন। এসপির কার্যালয়ে নারায়ণগঞ্জ-৫(শহর-বন্দর) এমপি একেএম সেলিম ওসমানের উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে এসপি বলেছিলেন, আইন সবার জন্য সমান। কেউ যদি জুয়ার বোর্ড চালায, মাদক ব্যবসা করে, চাঁদাবাজি করে কিংবা ভূমিদস্যূতা করে এখন সেখান থেকে যদি পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করে এবং সেই লোকটি যদি কারো হয়ে যায় তাহলে কোন সমস্যা নেই, আমরা আদালতে পাঠাবো, আপনারা অ্যাস পার ‘ল’ জামিন করিয়ে নিবেন।’ তার এমন বক্তব্যে নারায়ণগঞ্জের মানুষ ধারণা নিয়েছে অপরাধী যেই হোক তাকে তিনি ছাড়বেন না।

নারায়ণগঞ্জে মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ, ভূমিদস্যূ, সন্ত্রাসী সহ নানা অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন এসপি। কোন এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হলে সেখান থেকে প্রভাবশালীদেরও গ্রেপ্তার করে হাতে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে আদালতে পাঠিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ শহরে কয়েক হাজার অবৈধ হকারদের দখলে থাকা ফুটপাত উদ্ধার করেছেন এসপি। সেই সঙ্গে দিগুবাবুর বাজারের মীরজুুমলা সড়কটি এক সময় বাজার হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। এটি একটি সড়ক এটি মানুষ ভুলেই গিয়েছিল। যে সড়কটি ভিটি হিসেবে ইজারা দিয়ে দৈনিক চাঁদা আদায় করতো প্রভাবশালীরা। যেখানে মাসে প্রায় ৯০ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হতো। সেটিও তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন।

নারায়ণগঞ্জ শহরের তিনটি জুয়ার স্পটে অভিযান চালিয়ে তিনি সেখান থেকে প্রায় ৮০ জনের মত জুয়ারীকে গ্রেপ্তার করে তাদেরকে আদালতে পাঠান। একইভাবে ফতুল্লার পাগলায় মেরী আন্ডারসন নামক একটি জাহাজে মাদক বিরোধী অভিযান চালিয়ে অর্ধশত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ রকম অনেক কাজ করেছেন এসপি হারুন অর রশীদ। সর্বপরি তিনি যোগদানের পর আইনগতভাবে যা যা করেছেন তা নারায়ণগঞ্জে রীতিমত ভিন্ন রকম এক ইতিহাসই হয়ে থাকবে। যা অতীতের কোন এসপি নারায়ণগঞ্জে এসে যা করতে পারেননি তা তিনি করেছেন সাহসিকতার সাথে। যেখানে নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিকদের সহযোগীতাও কম নয়।

প্রশ্ন আসতে পারে নারায়ণগঞ্জের সুশীল সমাজ, রাজনীতিক কিংবা সাংবাদিকেরা কেন এসপির সকল কাজগুলোর প্রসংশা করছেন? ফলোও করে মিডিয়াতে প্রচার করছেন? তবে বাকিদের দেখি নাইবা গেলাম, আসি সাংবাদিকদের বিষয়টি নিয়েই। পুলিশ সুপার যখন প্রভাবশালীদের অবৈধ আয়ের উৎস বন্ধ করে দিচ্ছেন কিংবা অভিযুক্তকদের গ্রেপ্তার করছেন কিংবা প্রভাবশালীদের অপরাধ দমনে চাপে রাখছেন তখন সাংবাদিকেরা ফলাও করে সেগুলো প্রচার করছেন। সবাই কিন্তু ওই প্রভাবশালীদের প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ফ্লাট কিংবা আধুনিক মার্কেটে দোকান পেয়ে এসপির ভাল কাজের প্রসংশা করছেন বিষয়টি তেমনও নয়। সবাই তো আর ফ্লাট বা দোকান পায়নি।

কারন এসপির কাজগুলো প্রসংশার দাবিদার। নারায়ণগঞ্জের মানুষ আগে যা চিন্তাও করেননি তা ঘটিয়েছেন এসপি। এক সময় নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিকেরা সাহস করে কলম ধরতে পারতোনা। যা এসপি নিজেই বলেছেন, নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিকেরা আগে লিখতে পারতেন না। এখন সাহস করে লিখতে পারছেন।’

এখন আমার ভয়ের কারন কেবল একটাই। আগে লিখতে পারতো না, বর্তমানে সাংবাদিকেরা সাহস করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে লিখতে পারছেন। কিন্তু ভবিষৎ আবারো অতীতের অবস্থায় চলে যাবে কিনা তা নিয়েই আমার বড় শঙ্কা। পুলিশ বাহিনী নারায়ণগঞ্জে আপাতদৃষ্টে অপরাধ ও অপরাধীদের দমিয়ে রেখেছেন। অনেক মাদক ব্যবসায়ীরা এলাকা ছাড়া। অনেক অপরাধীরা গা ঢাকা দিয়েছে। তাদের খুজে পাওয়া যাচ্ছেনা।

অনেক অপরাধীদের মুখের ভাষ্য-এই এসপি আর কয় দিন? চলে গেলেই তো দেখা যাবে। কি দেখা যাবে? তারা নিশ্চয় কিছু দেখাবে। ইতিমধ্যে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে যারা বাদী হয়ে মামলা করেছেন তাদেরকে এমন হুমকি ধমকিও কিন্তু হয়েছে। যা মিডিয়াতেও প্রকাশিত হয়েছে। এখন আমারো প্রশ্ন একজন সরকারি কর্মকর্তা সব সময় একই এলাকায় থাকতে পারবেন না। কিন্তু তখন কি হবে নারায়ণগঞ্জের এই সব মানুষের যারা সাহস করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন? যারা অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন মামলা করেছেন? তারা কি থাকবেন নিরাপদ? তারা কি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন? কারন অপরাধীরা যখন আড়ালে চলে যায় তখন বলা যায় তারা আবার সময় সুযোগ বুঝে ফিরে আসবে। তারা সেই অপেক্ষায় দিন গুণছেন।

ছোট বেলায় পুকুরঘাটে বসে পুকুরের ছোট কচুরিপানায় ঢিল ছুঁড়তাম। তাতে ছোট ছোট কঢ়ুরিগুলো সরে যেতো। আবার একটি পরেই কুচরিগুলো মিলে যেতো। ভবিষৎে যদি ফিরে আসে নারায়ণঞ্জ থেকে আড়ালে থাকা মাদক ব্যবসায়ীরা? আবারো যদি ফুটপাত দখল, মীরজুমলা সড়ক দখল করে চলে চাঁদাবাজি? আবারো যদি চলে জুয়ার আসর? আবারো যদি ফিরে যায় আগের অবস্থানের নারায়ণগঞ্জ? তখন কি হবে?

তাই অপরাধীর শিকর তুলে ফেলতে হবে। মূল উৎপাটন করতে হবে। যাতে ভবিষৎে নারায়ণগঞ্জের অপরাধীরা মাথা চাড়া দিয়ে না ওঠতে পারে। দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। যাতে করে ভবিষৎে কোন অপরাধী যেনো একবার অপরাধ করার আগে তার অতীতে চিন্তা করে। নারায়ণগঞ্জের মানুষের ভবিষৎের কথা চিন্তা করি আমি বলব অপরাধী শুধু দমিয়ে রাখা নয়, তাদের মূল উৎপাটন করতে হবে। সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয় আরও জোড়ালো প্রয়োজন। মনে হয় সমন্বয়ের অভাব। জনপ্রতিনিধিরাও জনগণকে বুঝাতে হবে আমরাও একমত- চাই অপরাধমুক্ত শান্তির নারায়ণগঞ্জ। যা সাধারণ মানুষের কাছে ম্যাসেজটা দিতে হবে জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজ ও প্রশাসন সকলেই চায় সুষ্ঠ সুন্দর পজেটিভ নারায়ণগঞ্জ। অপরাধীরাও তখন গুটিয়ে যাবে। মাদক ব্যবসায়ীরা ফিরে আসলেও মাদক ব্যবসা চালানোর সাহস পাবে না। তাহলেই কেবল অপরাধী নির্মূল হবে। হবে শান্তির নারায়ণগঞ্জ।