মাজহারুল ইসলাম রোকন:
নারায়ণগঞ্জের বিএনপির রাজনীতি থেকে বিলিনের পথে বিএনপির একঝাঁক প্রবীণ রাজনীতিক। যারা এক সময় ছিলেন দাপটশালী আজকে তাদের অস্তিত্ব সংকটে। যাদের এক সময় ছিল বাঘের গর্জন আজকে তারা ডেড হর্স। নারায়ণগঞ্জে এমন বেশকজন নেতার রাজনীতি বেঁজে ওঠছে বিদায় ঘন্টা। আগের সেই অবস্থানে কাম ব্যাক করা তাদের জন্য অনিশ্চিত। আবার দুএকজন বাদে বাকিদের ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা একেবারেই ফিকে। ফলে নারায়ণগঞ্জ বিএনপি তরুণ রাজনীতিক নির্ভর হয়ে ওঠতে যাচ্ছে। তবে তরুণ রাজনীতিকদের অনেকেই প্রভাবশালী শিল্পপতি কিংবা ব্যবসায়ী মার্কা নেতাদের চাটুকারিতায় ব্যস্ত রয়েছেন। ফলে ভবিষৎে নেতৃত্ব সংকটে পড়তে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ বিএনপি।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিম:
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন রেজাউল করিম। তিনি নামের আগে অধ্যাপক ও মুক্তিযোদ্ধা শব্দ দুটি ব্যবহার করেন। যদিও দুটি শব্দ নিয়েই রয়েছে নানা বিতর্ক। রেজাউল করিম মুক্তিযোদ্ধা নয় এমন অভিযোগ তুলে সোনারগাঁয়ের মুক্তিযোদ্ধারা জোড়ালো প্রতিবাদ ও অভিযোগ তুলেছিলেন। তাকে ‘ভূয়া’ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সেই বিষয়টির সূরাহ করতে পারেননি রেজাউল করিম।
এছাড়াও তিনি নিজেকে দাবি করেন তিনি একজন অধ্যাপক যা তার দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আজহারুল ইসলাম মান্নান নিজেই অভিযোগ তুলেছেন- রেজাউল করিম অধ্যাপক নয়। নারায়ণগঞ্জে মহিলা দলের একটি অনুষ্ঠানে মান্নান বলেছিলেন, ‘রেজাউল করিম ভূয়া অধ্যাপক। আরেকবার সে অধ্যাপক দাবি করলে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।’ নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের বর্তমান জাতীয় সংসদ সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকাও অভিযোগ তুলেছেন- রেজাউল করিম ভূয়া অধ্যাপক ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা।
কিন্তু এই রেজাউল করিম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়নের প্রতিমন্ত্রী। নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে এশাধিকবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু এক এগারোর সময় দলের বর্তমান চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়েছিলেন। হয়েছিলেন সংস্কারবাদীদের অন্যতম একজন। এমন তকমা নিয়েই ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে মনোনয়ন পান তিনি এবং তরুণ প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল কায়সার হাসনাতের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন।
তারপর রাজনীতি থেকে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েন রেজাউল করিম। দলের ব্যানারে নিজের আখের গুছালেও রেজাউল করিম বিএনপির নেতাকর্মীদের বিপদে পাশে থাকেননি। তার এমন শূন্যস্থানে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য আজহারুল ইসলাম মান্নান। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি বিএনপি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চেয়েও পাননি রেজাউল করিম। এখানে মনোনয়ন পান আজহারুল ইসলাম মান্নান। বয়সের কারনেও রাজনীতিতে নেই রেজাউল করিম। বর্তমানে সোনারগাঁয়ের বিএনপির রাজনীতি পুরোদস্তর মান্নানের নিয়ন্ত্রণে। রেজাউল করিম দল ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রকারী সংস্কারবাদীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন।
সাবেক এমপি আতাউর রহমান খান আঙ্গুর:
আতাউর রহমান খান আঙ্গুর বিএনপির সাবেক তিন বারের এমপি। তিনি নারায়ণগঞ্জ-২(আড়াইহাজার) আসনে এমপি নির্বাচিত হন সেই ১৯৯১ সাল থেকে। আড়াইহাজারের একটি ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে ছিলেন তিনি। তার ভাই কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রয়াত ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক এএম বদরুজ্জামান খান খসরু আওয়ামীলীগ থেকে বিএনপিতে নিয়ে আসেন আঙ্গুুরকে। ওই সময় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন খসরু। যার ফলশ্রুতিতে বিএনপির টিকেট এনে দেন আঙ্গুরকে। পরবর্তীতে আপন ভাই খসরুর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন আঙ্গুুর। তবে আঙ্গুর ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে আড়াইহাজারের অবকাঠামোগত বেশ উন্নয়ন হয়েছে। যদিও তিনি এক এগারোর সময় দলের বিরোধীতা করে সংস্কারবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। এ আসনে গত নির্বাচনে মনোয়ন পান কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম আজাদ। ইতিমধ্যে এ আসনে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন আঙ্গুরের ভাতিজা মাহমুদুর রহমান সুমন।
সাবেক এমপি আবুল কালাম:
বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে একাধিকবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন অ্যাডভোকেট আবুল কালাম। তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার একটি ওয়ার্ড নির্বাচনে নিজের মনোনয়ন বাজেয়াপ্ত হওয়া এই বিএনপি পরবর্তীতে তিন বার এমপি নির্বাচিত ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে। বর্তমানে তিনি মহানগর বিএনপির সভাপতির পদে দায়িত্ব পালন করছেন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবুল কালাম দলের মনোনয়ন পাননি। নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে মনোনয়ন পান ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী এসএম আকরাম। ইতিমধ্যে মহানগর বিএনপির রাজনীতিতে আলোচনায় আসছেন মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান ও মহানগর যুবদলের সভাপতি মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। গত নির্বাচনে দলের প্রাথমিক মনোনয়ন পান আবুল কালাম ও খোরশেদ। কিন্তু চূড়ান্তভাবে এখানে প্রার্থীতা পান এসএম আকরাম। ইতিমধ্যে কালামের এলাকায় ভাগ বসিয়েছেন সাখাওয়াত ও খোরশেদ। তাদের ধাক্কায় সামনে আবারো দলের মনোনয়ন ভাগিয়ে আনতে পারবেন কিনা তা নিয়ে বেশ সংশয় রয়েছে। তিনিও এক এগারোর সময় দলের বিরোধীতাকারী সংস্কারবাদীদের সঙ্গে ছিলেন।
সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দীন:
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির গত কমিটি গঠনের পূর্বে আলোচনায় ছিলেন গিয়াসউদ্দীনই হচ্ছে জেলা বিএনপির কর্ণধার। তিনি ওই সময় নেতাকর্মীদের চিঠির মাধ্যমে প্রস্তুত থাকারও আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে জেলা বিএনপির দায়িত্ব দেয়া হয়নি। ২০০১ সালের নির্বাচনে জেলা কৃষকলীগের সহ-সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনের মাত্র ২১ দিন পূর্বে বিএনপিতে যোগদান করেই ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়ন পান। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের বর্তমান এমপি শামীম ওসমানকে পরাজিত করে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা দলের কমিটিতে তিনি রয়েছেন। এমপি হওয়ার পর তিনি ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করেন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি দলের মনোনয়ন পাননি।
খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা তৈমূর আলম:
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা পদে রয়েছেন। জেলা বিএনপির সেক্রেটারি পদেও দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে আহ্বায়ক এবং জেলা বিএনপির সভাপতি নির্বাচিত হন। গত কমিটি গঠনে তাকে রাখা হয়নি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্বে তিনি নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে নির্বাচনের ঘোষণা দিয় মাঠে নামেন। গত নির্বাচনে তিনি নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে মনোনয়ন চান। প্রাথমিকভাবে দলের মনোনয়ন পেলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে এখানে মনোনয়ন পান জেলা বিএনপির সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান। ২০০৬ সালে নির্বাচনের প্রস্তুতির সময় তৈমূর এ আসনে মনোনয়ন পেলেও এক এগারোর কারনে তিনি গ্রেপ্তার হলে কারাবন্ধি হন। ২০১১ সালে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তিনি দলের সমর্থন পেলেও ভোট গ্রহণের সাত ঘন্টা আগে তাকে বসিয়ে দেয় বিএনপি। নারায়ণগঞ্জের বিএনপির এক সময়কার নিয়ন্ত্রক এখন কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সক্রিয়।
খন্দকার আবু জাফর:
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি ও সোনারগাঁও উপজেলা বিএনপির সভাপতির পদে রয়েছেন খন্দকার আবু জাফর। ২০০১ সাল থেকে দলের মনোনয়ন চেয়ে আসলেও কোন নির্বাচনেই তিনি মনোনয়ন পাননি। নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে গত নির্বাচনে মনোনয়ন পান কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য আজহারুল ইসলাম মান্নান। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তিনি গিয়াসউদ্দীনকে নিয়ে সোনারগাঁয়ে রাজনীতিতে নামেন। গত নির্বাচনে জাফর প্রাথমিক পর্যায়ে মনোনয়ন পেলেও তিনি দলের মনোনয়ন পত্র দাখিলই করেননি। বর্তমানে সোনারগাঁয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রকের ভুমিকায় মান্নান। এক এগারোর সময় জেলা বিএনপির হাল ধরে থাকলেও পরবর্তীতে মুল্যায়ন পাননি তিনি। রেজাউল করিম অধ্যায় শেষে এখন মান্নানের নিয়ন্ত্রনে বিএনপি। আগের মত জাফর রাজনীতিতেও নেই।
সফর আলী ভুইয়া:
দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির আহ্বায়কের পদে রয়েছেন সফর আলী ভূঁইয়া। কিন্তু তিনি রাজনীতিতে নেই একেবারেই। ২০১৩ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির আহ্বায়ক করা হয় তাকে। কিছুদিন পর তিনি বিদেশে চলে গেলে সেখানে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করা হয় আলী হোসেন প্রধানকে। কিন্তু সফর আলী ভূঁইয়া দেশে ফিরে আসলেও তাকে আর দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। এ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে বিএনপির এক অনুষ্ঠানে দুই গ্রুপের নেতাকর্মীদের মাঝে ধস্তাধস্তিও হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পান তিনি। কিন্তু গিয়াসউদ্দীন বিএনপিতে যোগদান করলেও সফর আলীর মনোনয়ন বাতিল করে সেখানে গিয়াসউদ্দীনকে মনোনয়ন দেয়া হয়। তারপর থেকে সফর আলী ভূঁইয়া আর রাজনীতিতে ঘুরে দাড়াতে পারেনি। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার আহ্বায়ক হলেও তিনি এখন আর রাজনীতিতে নেই।
মুহাম্মদ শাহআলম:
শিল্পপতি মুহাম্মদ শাহআলম। কল্যাণপার্টির কোষাধ্যক্ষ থেকে বিএনপিতে যোগদান করেই নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে দলের মনোনয়ন পান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামীলীগের প্রার্থী সারাহ বেগম কবরীর কাছে পরাজিত হন। এরপর তিনি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা বিএনপির পাশাপাশি জেলা বিএনপির দাপুটে নেতা বনে যান। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি এবং ফতুল্লা থানা বিএনপির সভাপতি পদেও দায়িত্ব পালন করেন। যদিও কোনটাতেই তিনি সম্মেলনে করে পদ পাননি। দ্বিতীয় দফার কমিটিতেও তিনি একই পদে বহাল থাকেন। গত নির্বাচনে তিনি তার আসন থেকে দলের মনোনয়ন পাননি। নির্বাচনের পর তিনি নারায়ণগঞ্জের জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও ফতুল্লা থানা বিএনপির সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তবে তিনি কেন্দ্রীয় সদস্য পদে বহাল রয়েছেন। নিজের পিঠ বাঁচাতেই তিনি দুটি পদ ছেড়ে দেন এবং তার অনুগত নেতাদের দিয়েই ফতুল্লা থানা বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়। গত নির্বাচনে তার আসনে মনোনয়ন পান ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী।