সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:
প্রতিহিংসার রাজনীতি কত প্রকার ও কি কি হতে পারে তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেহ উপলব্দি করতে পারেনা। প্রতিহিংসাকে কার্যকর করার জন্য পূর্ব জামানার বিভিন্ন কৌশলের সাথে স্মরণকালে সম্পৃক্ত হয়েছে ‘আইন’ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। কারণ আইনকে অপপ্রয়োগ করে বা ইচ্ছামত আইন প্রনয়ণ করে রাষ্ট্রীয় সার্ভেন্টদের মাধ্যমে রাষ্ট্র নিজেই প্রজাদের নিপীড়ন করে, মনোবাসনা পূর্ণ করে তাদের যাদের হাতে থাকে রাষ্ট্রীয় দন্ডমূলের দাদাগীরি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বহু অপপ্রয়োগের কথাই পৃথিবীব্যাপী অনেক অনেক ঘটনা রয়েছে যা কিছু অংশ প্রকাশিত, বাকী অধিকাংশই রয়েছে অপ্রকাশিত, কোথাও প্রভাবশালীদের চাপে, কোথাও ভিন্ন ভিন্ন কারণে, তবে অধিকাংশই ক্ষেত্রেই নিপীড়িতদের দূর্বলতা ও মিডিয়ার পক্ষ পাতিত্বমূলক আচরণের কারণে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অনেক ঘটনাই হয় চাপা পড়ে থাকে, নতুবা প্রচারিত হয় ভিন্নভাবে। ইতিহাসের কোথাও ভিলেন হয়ে পড়ে নায়ক, নায়ক হয়ে পড়ে ভিলেন এবং পৃথিবীর অনেক ঘটনাই আছে যা নায়ক বা ভিলেন কেহ দায়ী নয়, বরং সংগঠিত হয়ে থাকে তৃতীয় পক্ষ দ্বারা।
কথা প্রসঙ্গে নিজের কথাই বলতে চাই। ২০০১ সালে ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জ শহরে চাষাঢ়ায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ অফিসে পৈচাশিক বোমা হামলায় ২২জন নিরীহ সাক্ষাৎকার প্রার্থী (পুরুষ/মহিলা) মানুষ নিহত হয়, যাদের মধ্যে নজরুল ইসলাম বাচ্চু নামে সম্ভবনাময় কন্ঠ শিল্পী নিহত হয়ে ছিল, শামীম ওসমান (তৎকালীন ও বর্তমান এমপি) সহ অনেকেই আহত হয়েছেন, চন্দনশীল নামে এক সম্ভবনাময় উদিয়মান রাজনৈতিক যুব ব্যক্তিত্ব চিরতরে একটি পা হারিয়েছেন, এমন পৈচাশিক ঘটনার নিন্দা জানানোর কোন সুযোগ পাই নাই, কারো দুঃখের সাথে নিজের অশ্রু ঝড়াতে পারি নাই।
কারণ সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০৫নং কক্ষে আমার কিউবিক্যালে বসে যখন ঘটনা শুনে আহত নিহতদের পাশে থাকার জন্য নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই জানতে পারি আমার নেতৃত্বে বোমা হামলার অভিযোগে আমার বাড়ীতে হামলা হয়েছে, আওয়ামীলীগের বিক্ষুব্দ লোকজন আমার বাড়ীর টিনের ঘর গুলি করে ঝাঝরা করে দিয়েছে, বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নেয়ায় আমার বৃদ্ধ পিতা মাতা এক কাপড়ে বাড়ী ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে, পরে আরো জানতে পারি যে, মিডিয়াতে প্রকাশিত হচ্ছে ‘তৈমূর আলম খন্দকারের নেতৃত্বে এই পৈচাশিক হামলা।’
এ সংবাদ শুনে মুড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (রূপগঞ্জ) সাবেক ইউপি সদস্য মফিজ মেম্বারের পুত্র ছাত্রদল নেতা শফিক সুপ্রীম কোর্ট থেকে হোন্ডা করে আমাকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গোপন স্থানে রেখে আসে। পরে জানতে পারি আমাকে প্রধান আসামী করে আরও ২৬ জনের নাম উল্লেখ করে নারায়ণগঞ্জ থানায় ৯(৬)২০০১ ধারা ৩০২ দ: বি: এবং নারায়ণগঞ্জ থানায় ১০(৬)২০০১ ধারা ৩/৪ বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুইটি পৃথক মামলা করা হয়। মামলা হওয়ার পর নিজের উপর ধিক্কার জন্মে এ জন্য যে, ঘটনার সাথে যাদের সম্পৃক্ততা নাই তাদেরকে ২২ জন লোক হত্যায় জড়িয়ে দেয়ার নামই কি রাজনীতি?
মিডিয়ার সংবাদ শুনে আমার জৈষ্ঠ্য কন্যা ভিকারুননেছা স্কুলের তৎকালীন ছাত্রী (ব্যারিস্টার মার-ই-য়াম) আত্মগোপন অবস্থায় টেলিফোনে আমাকে বলেছিল যে, ‘রাজনীতির কারণে কি তোমরা বোমা মেরে মানুষ খুন করতে পারো?’ এ ধরণের অপবাদের মানসিক যন্ত্রনা মাথায় নিয়ে আমাকে কাটাতে হয়েছে ১৩টি বৎসর। আমাদের বিরুদ্ধে ঘটনার সম্পৃক্ততা না পেয়ে উক্ত মামলাগুলিতে পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট দেয়, সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপতি জুডিশিয়াল ইনকুয়ারী করে আমাদের নির্দোষে মন্তব্য করে ঘটনাটি তৃতীয় পক্ষ দ্বারা সংগঠিত হয়েছে বলে মন্তব্য করে প্রতিবেদন দেন।
২০০৮ ইং সালের ডিসেম্বর মাসে বাদী পক্ষের আবেদনে মামলাটি আবার পুণরায় চালু হয়। দীর্ঘ ১৩ বৎসর মামলাটি অমানুসিক যন্ত্রনা মাথায় নিয়ে চলাবস্থায় ০২/০৫/২০১৩ ইং তারিখে জানতে পারি যে, উক্ত পৈচাশিক ঘটনার সাথে আমাদের কোন সম্পৃক্ততা না থাকায় সি.আই.ডি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে মোকদ্দমা থেকে আমাদের অব্যাহতি দেয়ার প্রার্থনা করে।
এ ঘটনায় যারা মৃত্যুবরণ বা আহত হয়েছে তারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন ক্ষতিপূরণ পেয়েছে কি না জানি না, তবে এ ক্ষতিপূরণ হওয়ার মত নয়। কারণ যারা নিহত বা আহত হয়েছে তারা ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ। এ মামলার অন্যতম আসামী জাহাঙ্গীর কমিশনার, রফিক কমিশনার দুনিয়া থেকে চলে গেছে। পৃথিবী থেকে আমরা চলে যাবো, কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের রেখে যাচ্ছি, তাই এ ধরণের ঘটনায় কোন চির-শক্রুর মৃত্যু চাইনা এবং মিথ্যাভাবে কোন চির শক্রুকেও যেন আসামী না করা হয়।
পৃথিবী হয়তো একদিন করোনা মুক্ত হবে, কিন্তু প্রতিহিংসা বা বর্ণ ও ধর্মীয় বৈষম্যের ভাইরাস থেকে মুক্ত হবে কি না জানি না, তবে দৃশ্যপট বলে প্রতিহিংসার ভাইরাস করোনা ভাইরাস থেকে আরো জঘন্য ও নির্মম। মানুষ হত্যা এবং হত্যা মামলায় জেনে শুনে নির্দোষ ব্যক্তিকে জড়িয়ে আসামী করার পৈচাশিক সংস্কৃতি থেকে পৃথিবী মুক্তি পাক এটা দৃঢ়ভাবে কামনা করি।
প্রতিহিংসার কারণে রাজপথে যে গুলি খেয়েছি, তা শরীরে এখনো বহন করছি, একই ঘটনায় নিহত হয়েছিল সহকর্মী ইব্রাহিম। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আমাকে, আমার পরিবার ও সহকর্মীদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন অকারনে মিথ্যা মামলায় জর্জরিত করেছে, বাড়ী হামলা করেছে, নারায়ণগঞ্জের আমার চেম্বার পুড়িয়ে দিয়েছে, পুলিশ দ্বারা রাজপথে বার বার শারীরিকভাবে নির্যাতিত ও নিগৃত হয়েছি। রাষ্ট্রীয় সার্ভেন্ট যারা আমাদের গায়েবী মামলা দিয়েছে, বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে, তাদের সকলকেই আল্লাহ মাফ করে দিন, আমি যদি কারো প্রতি প্রতিহিংসামূলক আচরণ করে থাকি, তার নিকট আমিও জোর হাতে মাফ চাই।
বিআরটিসি’র দীর্ঘ সময় চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় যদি কোন বৈষম্যমূলক আদেশ, নির্দেশ, আচরণ করে থাকি তার জন্যও মাফ চাই। বিভিন্ন সংগঠন ও দল পরিচালনায় যদি অনুরূপ কোন আচরণ হয়ে থাকে তার জন্যও মাফ চাই। অনেক কারণেই মনটি বিদ্ধস্থ হয়ে যায়, কারণ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় ২০০৩ সালে ‘নিজের জানাযায় অংশ গ্রহণের আহব্বান জানিয়ে বক্তৃতা’ দিয়ে এক ভাই (সাব্বির আলম খন্দকার) নিজেই খুন হলো, এখনো বিচার পাই নাই। তবুও অহেতুক একজন অপরজনকে দোষারূপ করার সংস্কৃতি থেকে মুক্তি চাই, প্রতিহিংসা থেকে মুক্তি চাই, সমাজে একটি স্থিতিশীলতা দৃঢ় চিত্তে কামনা করি। করোনা ভাইরাস যেন আমাদের কিছু নৈতিকতা শিক্ষা দিয়ে যায়।
শেষ কথা বলতে চাই এভাবে যে, রাজনীতি যায় যায়: কিন্তু “সকলে আমরা সকলের তরে”। করোনার মধ্যে কনিষ্ঠ ভ্রাতা খোরশেদ দম্পতির হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ সৃষ্টির সুবাদে সহমর্মিতার যে দীক্ষা নারায়ণগঞ্জে উকি দিয়ে গেলো তা যেন আলোর মুখ দেখতে পায়। ১৬ই জুনের পৈচাশিকতায় যারা আহত নিহত হয়েছে তাদের শান্তনা দেয়ার কোন ভাষা আমার জানা নাই, তাই মিথ্যা শান্তনা না দিয়ে শুধু আল্লাহকে বলছি, হে আল্লাহ সমস্ত প্রকার পৈচাশিকতা থেকে আমাদের হেফাজত করুন, আপনার সৃষ্টিকে রক্ষার জন্য আপনিই একমাত্র হেফাজতকারী। এ দায়িত্ব নেয়ার জন্য অন্য কাহারো শক্তি নাই।
লেখক: তৈমূর আলম খন্দকার
কলামিস্ট ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এপিলেট ডিভিশন