কোরবানীর হাট বনাম রাজনীতির মাঠ

সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:

রমজান ও ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদের এবারের আনন্দ মাটি হয়ে গেলো করোনা ভাইরাস আতঙ্কে। একই সাথে বাঙ্গালীর বৈশাখী উৎসব এবং রোজার ঈদের মন্দাভাবে ক্রয় বিক্রয়ের অভাবে উদ্দোক্তা, বিক্রেতা, দোকানী সহ ব্যবসার সাথে জড়িত সকলেরই কপালে হাত পড়েছে, যা আমাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি দু:সংবাদ। করোনা শুধু উল্লেখিত উৎসব আনন্দের দিনগুলি মাটি করে দেয় নাই, বরং অনেক আখাংকিত উৎসবও বেদনায় পরিনত হয়েছে। এ জন্যই ইংরেজীতের একটি প্রবাদ রয়েছে যে, Man Proposes, but god opposes। বাংলায় প্রবাদটি আরো হতাশাজনক, তা হলো “অতি আশা নিষ্ফল।” সময়ে সময়ে এ ধরনের পরিস্থিতি ব্যক্তি, পরিবার, জাতীয় এবং সামাজিক অবস্থানকে বিপর্যস্থ করে দিলেও “আশা” নিয়েই মানুষকে বেচে থাকতে হয়। এ কথাও দ্রুব সত্য যে, বিপদ, মহামারী কোন কালেই চিরস্থায়ী হয় নাই। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সূরাহ আশ্-শারহ ৫ ও ৬নং আয়াতে দুইবার বলেছেন, “নিশ্চয় কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি।

আল্লাহপাকের নিকট হতে নিরাশ বা হতাশা হওয়ার কোন কারণ নাই। তিনি উত্তম কাজের জন্য উৎসাহিত করে বলেছেন যে, “উত্তম কাজের জন্য উত্তম পুরষ্কার ব্যতীত আর কি হতে পারে?” (সূরা আর-রহমান, আয়াত-৬০)। সৃষ্টি কর্তা মানবজাতির নিকট থেকে উত্তম কর্মই প্রত্যাশা করেন। কিন্তু যখনই এর ব্যপ্তয় ঘটে তখনই নেমে আসে করোনা ভাইরাসের মত কঠিন বির্পজয়। তিনি (সৃষ্টি কর্তা) আল-কোরানে বারংবার বলেছেন যে, আমি মানবজাতি ও জিনের হিসাব গ্রহণে অত্যন্ত তৎপর।

রোজার ঈদ ও কোরবানীর ঈদ (ঈদ-উল-আযহা) মুসলমানদের বড় উৎসব হলেও ২টি ঈদের বানিজ্যিক বিনিয়োগ ভিন্নতর। রোজার ঈদে একটি পরিবারের মূল বাজেট খরচ হয় পোষাক পরিচ্ছদ, প্রসাধনী ও উপভোগ্য বস্তু ভিত্তিক। কিন্তু কোরবানী ঈদ যদি করোনার কারণে বাধাগ্রস্থ হয় তবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে একটি ব্যবসায়িক গোষ্টি যারা শুধুমাত্র কোরবানীর ঈদকে টার্গেট করে গরু, ছাগল, মহিষ প্রভৃতি পশু বানিজ্যিক ভিত্তিক লালন পালন করে, এতে ব্যাংক ঋণ সহ বিভিন্ন প্রকার বিনিয়োগ জড়িত রয়েছে। চলতি বাজেটে বিদেশ থেকে আমদানী করা পেয়াজের উপর শুল্ক ধার্য করা হয়েছে।

এতে যদি বিদেশী পেয়াজের মূল্য বৃদ্ধি পায় তবে বাংলাদেশের কৃষকরা দেশী পেয়াজ চাষে উৎসাহীত হবে। তবে এ জন্য সংশ্লিষ্ট চাষীদের পর্যাপ্ত পরিমাণ চাষাবাদের জন্য সরকারী সূযোগ সুবিধা প্রদান করতে হবে। নতুবা সিন্ডিকেটের তৎপরতায় পূনরায় পেয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়বে, ফলশ্রুতিতে জনদূর্ভোগ আরো বৃদ্ধি পাবে। সরকার ভারত থেকে গরু আমদানী বা চোরাই পথে গরু বাংলাদেশে প্রবেশ বন্ধ রাখতে পারলে দেশীয় গরু খামারীরা ব্যবসায়ীক লাভবান হবে। তবে এতে গরুর মাংসের মূল্য বৃদ্ধি পাবে বটে। তারপরও আমি মনে করি যে, যদি ভারতীয় গরু দেশে প্রবেশ বন্ধ রাখা যায় তবে দেশীয় গবাদি পশু উৎপাদনে দেশীয় গবাদি খামারীরা ব্যাপক ভাবে উৎসাহিত হবে, এ মর্মে প্রান্তিক খামারীরা যাহাতে সহজভাবে সরাসরি সরকারী সহযোগীতা পায় এ জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।

এতোগেল কোরবানীর হাটের দূরবস্থা, কিন্তু রাজনীতির মাঠ যে করোনা ভাইরাসের বহু পূর্বেই দিনে দিনে মানব পাচারকারী, অর্থ পাচারকারী, দূর্নীতি পরায়ন উচ্চ বিলাসী আমলা, ভূমিদস্যু, ব্যাংক লুটেরাদের হাতে জিম্মি হয়ে গেলো, আগা গোড়া তারা পূরোটাই গিলে খাচ্ছে, এ থেকে দেশবাসীর পরিত্রাণের উপায় কি? দেশের ৯০% সম্পদ একটি শ্রেণীর হাতে বন্দী হয়ে আছে। তারা গাছের উপরের টা তো খায়ই, তলের টাও কুড়িয়ে নেয়। রাজনৈতিক মাঠটি বিত্তশালীদের বদৌলতে কুলষিত এবং একছত্র আধিপত্যের কারণে সাধারণ নাগরিকদের বিনা চিকিৎসায় মরতে হচ্ছে, হাসপাতালে ভর্তি তাদের জন্য যেন একটি “অরন্য রোদন”। জেলা সদরে তো দূরের কথা ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে আই.সি.উ নাই, যে কয়টা আছে তা ভি.ভি.আই.পি’দের জন্য রিজার্ভ করা। মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিষ্ঠিত জাতীয় সাংবাদিক, ভাষা সৈনিক কামাল লোহানী ৮৬ বৎসর বয়সে (পরিবারের পক্ষ থেকে) বহুবার আবেদন করেও সিএমএইচ এ একটি আইসিইউ’তে চিকিৎসা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ২০/৬/২০২০ ইং তারিখে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। এতে সরকার লজ্জিত না হলেও দেশের বিবেকবান মানুষেরা নিশ্চয় লজ্জিত হওয়ার কথা। উল্লেখ্য, হাই কোর্ট সাধারণ নাগরিকদের হাসপাতালে ভর্তির বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করে বলেছেন যে, হাসপাতালে ভর্তি না করাটা একটি ফৌজদারী অপরাধ। হাসপাতালগুলি অক্সিজেন নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত ব্যবসা করে বিধায় হাই কোর্ট এ মর্মেও নির্দেশনা প্রদান করেছেন যাহাতে অতিরিক্ত মূল্য না নেয়া হয়। যে কাজগুলি করার কথা ছিল জন প্রতিনিধিদের, সে কাজগুলি করতে হচ্ছে হাই কোর্টকে।

বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ বিজ্ঞশালীদের একটি ক্লাবে পরিনত হওয়ার কারণে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন অত্যান্ত দূর্বল। কারণ আমাদের ভাগ্য বিধাতা যারা সংসদে বসে আছে তাদের কাশি, শর্দি, জ্বর হলেও বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার জন্য চলে যেতো। ফলে হাসপাতালগুলির অবস্থা কি তা তাদের দেখতে হয় নাই। বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ ৪ মাস অতিক্রম হতে চললো, ৮ই মার্চ করোনায় প্রথম মৃত্যু সনাক্ত হয়। প্রতিদিনই মৃত্যু হচ্ছে যা একদিনে গড়ে ৪৫-৫০-৫৩ সংখ্যা দাড়িয়ে যায়। কিন্তু সরকার এখনো চিকিৎসা ব্যবস্থায় একটি গতি ফিরিয়ে আনতে পারলো না, তা স্বত্বেও কিছু মন্ত্রীদের লম্ফজম্ফ মূখরোচক কথায় সাধারণ নাগরিকদের আর পেট ভরছে না। রাজনৈতিক মাঠ যদি জনগণের নিয়ন্ত্রণে থাকতো অর্থাৎ জনগণের নিকট জবাব দিহি করতে হতো তবে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় যে, অতিকথন স্বভাব যদি তথ্যমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতার মাপকাঠি হয়ে থাকে তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা যথার্থই আছে, কিন্তু অতিকথনে যারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তারা এ স্বভাবকে তাদের একটি কোয়ালিফিকেশন মনে করলেও জনগণ তা কতটুকু মূল্যায়ন করে সে বোধদয় পূর্ববর্তী বক্তাদেরও হয় নাই এবং “বর্তমান” তো আরো কয়েক ডিগ্রী এগিয়ে।

“জবাবদিহিতার” প্রশ্নে প্রশ্ন করাটাই যেন একটা বোকামী। এখন নীতি, আদর্শ লাগে না, উপর তলার একটি “ছায়া” হলেই অনায়াসে, বিনা ভোটে চেয়ার দখল করে জনপ্রতিনিধিমূলক পদ পদবী পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নগদ অর্থ সহায়তা, হতদরিদ্র জনসাধারনের জন্য বরাদ্দকৃত চাল আত্মসাৎ এবং স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে উপকারভোগীদের তালিকা প্রনয়নের অনিয়মসহ বিভিন্ন অভিযোগে করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাব শুরু হওয়ার পর থেকে ১৭/৬/২০২০ ইং পর্যন্ত ১০০ জনপ্রতিনিধীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৩০ জন ইউ.পি চেয়ারম্যান, ৬৪ জন ইউপি সদস্য, একজন জেলা পরিষদ সদস্য, চারজন পৌর কাউন্সিলর এবং একজন উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান (সূত্র: জাতীয় দৈনিক তাং- ১৮/৬/২০২০)। আর্টিকেলটি প্রকাশ হওয়ার দিন এ সংখ্যা হয়তো আরো বৃদ্ধি হতে পারে। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে, মানুষ যখন প্রতি মুহুর্তে মৃত্যু আতঙ্কে ভুগছে তখন জনপ্রতিনিধিরা ত্রাণের টাকা আতœসাৎ করে, তা কি একজন সুস্থ্য বিবেক সম্পন্ন মানুষের পক্ষে সম্ভব? নিজের বিবেকের নিকট যদি নিজের জবাব দিহিতা থাকতো তবে এ ধরনের পৈশাচিকতা কোন জনপ্রতিনিধির পক্ষে সম্ভব হতো কি?

বাঙ্গালী জাতির আন্দোলন সংগ্রামের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এ জাতি প্রতিবাদ মূখী, কিন্তু জাতি এখন আদর্শ ভিত্তিক রাজনীতি অনুকরণ ও অনুশীলন বিমূখ হয়ে পড়েছে। রাজনীতির মাঠ এখন কোরবানীর হাটে রূপান্তরিত হয়েছে। এক হাটে বিক্রি না হলে তো অন্য হাটে তো বিক্রি হবেই। রাজনৈতিক দলগুলিও এখন আর্দশের ধার ধারে না। এক দল থেকে বাদ দিলে টাকা থাকলে অন্য দল সাদরে আমন্ত্রন জানায়, ফলে জীবনার্দশের সাথে রাজনৈতিক আদর্শের সামানজস্য থাকা বর্তমানে রাজনৈতিক মাঠে অত্যাবশ্যক নহে। শুধুমাত্র নির্বাচনে জয়লাভ করার মত বিত্তশালী প্রার্থীই এখন দলগুলির বেশী পছন্দ। ফলে বিত্তশালীরা নমিনেশন বানিজ্যে এগিয়ে থাকে এবং ক্ষমতা পেয়েই শুরু করে ক্ষমতার অপব্যবহারিক বানিজ্য এবং তাদের বানিজ্যিক অধিক্ষেত্রে রয়েছে ত্রান, উন্নয়ন, হাট বাজারের মাসোহারা, নিয়োগ, বদলী, সরকারী ক্রয় বিক্রয়, টেন্ডার প্রভৃতি। অধিকন্তু তদবীর বানিজ্যতো রয়েছেই। এ জন্য রাজনীতিতে দলীয় প্রধানের নেতৃত্বের ব্যর্থতার পাশাপাশি জনগণের চোখ বন্ধ রাখার মনমানসিকতা অনেকাংশে দায়ী। কারণ বাংলার জনগণ এখন প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে তোলা ভুলে গেছে। এখন দেশ, জাতি ও রাজনীতি চলছে ভিন্ন স্বাদ ও সংস্কৃতিতে, তবে জাতীয় স্বার্থে এর অবসান হতেই হবে এবং জনতার বিবেক অবশ্যই একদিন জেগে উঠবে, ইনশাআল্লাহ, নতুবা স্বাধীনতার স্বাদ দেশের আপামর জনগণ কোন দিনই ভোগ করতে পারবে না।

রাজনীতিতে এখন চলছে ভানুমতির খেলা। পকেট ভারী তো খেলা আছে, পকেট খালি তো খেলা খতম, অর্থাৎ যে রাজনীতিকের হাতে অঠেল টাকা নাই তার জন্য রাজনৈতিক অধিক্ষেত্র একটি মরুভূমির মরিচিকা মাত্র। জনগণও প্রতারিত হতে হতে তাদের একটি অংশ এখন টাকা ওয়ালাদেরই ক্ষনিকের “দাতা হাতেমতাই” মনে করে “নগদে যা পায় তাই হাত পেতে নেওয়ার” নীতিকেই প্রাধান্য দেয়ায় এখন মূখ বুঝে সব অনাচার সহ্য করে নিচ্ছে। জনগণইবা যাবে কোথায়? জনগণ আস্থায় আনতে পারে সেই আস্থাশীল পরিবেশ এখন কোথায়? বিনা ভোটের সংস্কৃতিতে কথিত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে নিজেদের কতটুকু দায়বদ্ধ করতে পেরেছেন? স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখন কি শুধুমাত্র ভি.ভি.আই.পি’দের জন্য? বাংলাদেশে মেঘা প্রকল্পের কথা সরকারের মূখে মূখে, অথচ মেঘা দূর্নীতির সংবাদও সুনির্দিষ্ট আকারে খাত ওয়ারী জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ পাচ্ছে। একশ্রেণীর মানুষের নিকট দেশবাসী জিম্মি হয়ে পড়েছে, রাষ্ট্রটি যেন কারো কারো পকেটে চলে গেছে, ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে যা চলতে দেয়া যায় না। হাসপাতালে রোগী ভর্তি নেয় না, অন্য দিকে আই.সি.ইউ’র অভাবে দিনে দিনে মৃত্যু মিছিল ভারী হওয়ার কাহিনী, পাশা পাশি রয়েছে রোগীদের নিম্নমানের ও বাসী পচা খাবার পরিবেশনের মর্মান্তিক কাহিনীর সংবাদ পত্রিকার পাতায়। নাগরিকদের স্বচ্ছ ভোটে যদি এদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকতো, তবে এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিশ্চয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বহীনতার পরিচয় ভোটারগণ দেখতে পেতো না। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় মনে হচ্ছে যে, চিকিৎসার আশায় হাসপাতালে ভর্তির উদ্দেশ্যে গাড়ীতে মুত্যবরণ না করে বিনা চিকিৎসায় বাড়ীতেই মৃত্যুবরণ কম কষ্ঠদায়ক বলে ভুক্তভোগীরা মনে করছে। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটুকু ভংঙ্গুর করোনার আর্ভিরবাব না হলে তা চাপাবাজীর চোটে তা আঁচ করা যেতো না। হাসপাতালগুলি এখন সেবার কেন্দ্রস্থল নহে, বরং অত্যাধিক একটি লোভনীয় ও লাভজনক ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছে।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসকদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই ৪০/৪৫ জন চিকিৎসক মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের প্রতি রইল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। একজন রোগীর মৃত্যুতে খুলনার ডা: রাকিবের উপরে হামলার কারণে মৃত্যু নিশ্চয় দেশ ও জাতির জন্য দু:সংবাদ। স্বজন হারাদের ধৈর্য হীনতা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উপরে অনাস্থার কারণেই এ ধরনের ঘটনার সূত্রপাত। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কোন কারণেই কাম্য নহে। এ জন্য সকল পক্ষেরই সচেতন হওয়া আবশ্যক।

প্রতিহিংসার রাজনীতি কত প্রকার ও কি কি হতে পারে তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেহ উপলব্দি করতে পারে না। প্রতিহিংসাকে কার্যকর করার জন্য পূর্ব জামানার বিভিন্ন কৌশলের সাথে স্বরণ কালে সম্পৃক্ত হয়েছে “আইন” ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। কারণ আইনকে অপপ্রয়োগ করে বা ইচ্ছা মত আইন প্রনয়ণ করে রাষ্ট্রীয় সার্ভেন্টদের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেই ভিন্নমতবালম্বী নাগরিকদের নিপীড়ন করে, মনোবাসনা পূর্ণ করে তাদের যাদের হাতে থাকে রাষ্ট্রীয় দন্ডমূলের দাদাগীরি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বহু অপপ্রয়োগের কথাই পৃথিবীব্যাপী অনেক অনেক ঘটনা রয়েছে যা কিছু অংশ প্রকাশিত, বাকী অধিকাংশই রয়েছে অপ্রকাশিত, কোথাও প্রভাবশালীদের চাপে, কোথাও ভিন্ন ভিন্ন কারণে, তবে অধিকাংশই ক্ষেত্রেই নিপীড়িতদের দূর্বলতা ও মিডিয়ার পক্ষ পাতিত্বমূলক আচরণের কারণে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অনেক ঘটনার সংবাদ হয় চাপা পড়ে থাকে, নতুবা প্রচারিত হয় ভিন্নভাবে। ইতিহাসের পাতায় কোথাও ভিলেন হয়ে পড়ে নায়ক, নায়ক হয়ে পড়ে ভিলেন এবং পৃথিবীর অনেক ঘটনাই আছে যা নায়ক বা ভিলেন কেহ দায়ী নয়, বরং সংগঠিত হয়ে থাকে তৃতীয় পক্ষ দ্বারা। কথা প্রসঙ্গে নিজের কথাই বলতে চাই। ২০০১ সালে ১৬ জুন নারায়নগঞ্জ শহরে চাষাঢ়ায় তৎকালিন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ অফিসে পৈচাশিক বোমা হামলায় ২২ জন নিরীহ সাক্ষাৎকার প্রার্থী (পুরুষ/মহিলা) মানুষ নিহত হয়, যাদের মধ্যে জনপ্রিয় কাউন্সিলর বাপ্পি, ছাত্রলীগ নেতা আখতার, মশু নামে দুই ভাই, নজরুল ইসলাম বাচ্চু নামে সম্ভবনাময় কন্ঠ শিল্পী নিহত হয়ে ছিল, শামীম ওসমান (তৎকালিন ও বর্তমান এম.পি) সহ অনেকেই আহত হয়েছেন, চন্দনশীল নামে এক সম্ভবনাময় উদিয়মান রাজনৈতিক যুব ব্যক্তিত্ব চিরতরে পা হারিয়েছেন, এমন পৈচাশিক ঘটনার নিন্দা জানানোর কোন সূযোগ পাই নাই, তখন কারো দু:ক্ষের সাথে নিজের অশ্রু ঝড়াতে পারি নাই। কারণ সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবি সমিতির ২০৫নং কক্ষে আমার কিউবিক্যালে বসে যখন ঘটনা শুনে আহত নিহতদের পাশে থাকার জন্য নারায়নগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই জানতে পারি আমার নেতৃত্বে বোমা হামলার অভিযোগে আমার বাড়ীতে হামলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের বিক্ষুব্দ লোকজন আমার বাড়ীর টিনের বাংলো টাইপ ঘর “গুলি” করে ঝাঝরা করে দিয়েছে, বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নেয়ায় আমার বৃদ্ধ পিতা মাতা এক কাপড়ে বাড়ী ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে, পরে আরো জানতে পারি যে, মিডিয়াতে প্রকাশিত হচ্ছে “তৈমূর আলম খন্দকারের নেতৃত্বে এই পৈচাশিক বোমা হামলা।”

এ সংবাদ শুনে মুড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (রূপগঞ্জ) সাবেক ইউপি সদস্য মফিজ মেম্বারের পুত্র ছাত্রদল নেতা শফিক সুপ্রীম কোর্ট থেকে হোন্ডা করে আমাকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গোপন স্থানে রেখে আসে। পরে জানতে পারি আমাকে প্রধান আসামী করে বিএনপি’র আরও ২৬ জনের নাম উল্লেখ করে নারায়নগঞ্জ থানায় ৯(৬)২০০১ ধারা ৩০২ দ: বি: এবং নারায়নগঞ্জ থানায় ১০(৬)২০০১ ধারা ৩/৪ বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুইটি পৃথক মামলা করা হয়। মামলা হওয়ার পর নিজের উপর দ্বিক্কার জন্মে এ জন্য যে, ঘটনার সাথে যাদের সম্পৃক্ততা নাই তাদের’কে ২২ জন লোক হত্যায় জড়িয়ে দেয়ার নামই কি রাজনীতি? মিডিয়ার সংবাদশুনে আমার জেষ্ঠ্যেকন্যা ভিকারুননেছা স্কুলের তৎকালীন ছাত্রী (ব্যারিস্টার মার-ই-য়াম তৈমূর) আত্মগোপন অবস্থায় মোবাইল টেলিফোনে আমাকে বলে ছিলো যে, “রাজনীতির কারণে কি তোমরা বোমা মেরে মানুষ খুন করতে পারো?” এ ধরনের অপবাদের মানসিক যন্ত্রনা মাথায় নিয়ে আমাকে কাটাতে হয়েছে ১৩টি বৎসর।

ঘটনার কিছুদিন পরেই নিজের আতœবিশ্বাস নিয়ে হাই কোর্টে এন্টিসিপেটরী জামিনের জন্য আমি একাই আত্মসমর্পন করি। তৎকালিন এ্যাডিশনাল এ্যাটর্নী জেনারেল (বর্তমান এ্যাটর্নী জেনারেল) আমার জামিনের ঘোর বিরোধীতা করলে হাই কোর্ট জানতে চায় যে, এজাহারের ভাষ্য মতে আমার বিরুদ্ধে কোন তথ্য রাষ্ট্র পক্ষ উপস্থাপন করতে পারবে কিনা? এবং একই ব্যক্তি তৈমূর আলম খন্দকারের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বেও একাধিক মামলার বাদী হওয়ার কারণ কি? রাষ্ট্র পক্ষ এ সকল তথ্য প্রমাণ দাখিল করার জন্য একদিনের সময় প্রার্থনা করলে আমাকে একদিনের অস্থায়ী জামিন দিয়ে এজাহারের সমর্থনে তথ্যাদি উপস্থাপনের জন্য তৎকালিন এ্যাডিশনাল এ্যাটর্নী জেনারেলকে নির্দেশ দেন। পরের দিন আমার জামিনের প্রতিবাদে নারায়নগঞ্জে অর্ধদিবস হরতাল আহবান করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। চূড়ান্ত শুনানীতে আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোন তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারে নাই বিধায় হাই কোর্ট আমাকে এন্টিসিপেটরী জামিন মঞ্জুর করেন।

আমাদের বিরুদ্ধে ঘটনার সম্পৃক্ততা না পেয়ে উক্ত মামলাগুলিতে পুলিশ ফাইনাল রির্পোট দেয়, সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপতি জুডিশিয়াল ইনকুয়ারী করে আমাদের নির্দোষ মন্তব্য করে ঘটনাটি তৃতীয় পক্ষ দ্বারা সংগঠিত হয়েছে বলে প্রতিবেদন দেন। ২০০৮ ইং সালের ডিসেম্বর মাসে বাদী পক্ষের আবেদনে মামলাটি আবার পুন: চালু হয়। দীর্ঘ ১৩ বৎসর মামলাটি অমানুষিক যন্ত্রনা মাথায় নিয়ে চলাবস্থায় ০২/০৫/২০১৩ ইং তারিখে জানতে পারি যে, উক্ত পৈচাশিক ঘটনার সাথে আমাদের কোন সম্পৃক্ততা না থাকায় সি.আই.ডি উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে মোকদ্দমা থেকে আমাদের অব্যাহতি দেয়ার প্রার্থনা করেছে। এ ঘটনায় যারা মৃত্যু বরণ বা আহত হয়েছে তারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন ক্ষতিপূরণ পেয়েছে কি না জানি না, তবে এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার মত নয়। কারণ যারা নিহত বা আহত হয়েছে তারা ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ। এ মামলার অন্যতম আসামী জাহাঙ্গীর কমিশনার, রফিক কমিশনার দুনিয়া থেকে চলে গেছে। পৃথিবী থেকে আমরা চলে যাবো, কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের রেখে যাচ্ছি, তাই এ ধরনের ঘটনায় কোন চির-শক্রুর মৃত্যু চাই না এবং মিথ্যা ভাবে কোন চির শক্রুকেও যেন আসামী না করা হয়। পৃথিবী হয়তো একদিন করোনা মুক্ত হবে, কিন্তু রাজনীতি প্রতিহিংসা বা বর্ণ ও ধর্মীয় বৈষম্যোর ভাইরাস থেকে মুক্ত হবে কি না জানি না, তবে দৃশ্যপট বলে বৈষম্য ও প্রতিহিংসার ভাইরাস করোনা ভাইরাস থেকে আরো জঘন্য ও নির্মম। মানুষ হত্যা এবং হত্যা মামলায় জেনে শুনে শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য নির্দোষ ব্যক্তিকে জড়িয়ে আসামী করার পৈচাশিক সংস্কৃতি থেকে পৃথিবী মুক্তি পাক, এটা দৃঢ়ভাবে কামনা করি। দৃঢ় চিত্তে কামনা করি, করোনা যেন আমাদের কিছু নৈতিকতা শিক্ষা ও দীক্ষা দিয়ে যায়।

লেখক: তৈমূর আলম খন্দকার
রাজনীতিক, কলামিষ্ট ও আইনজীবি (এ্যাপিলেট ডিভিশন)