সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:
ফুটবল মাঠে লড়াকু সৈনিক। রক্ষণভাগের বাঘা বাঘা ডিফেন্ডারের বাধা পেরিয়ে বিপক্ষ দলের জালে বল জড়ানোই তার কাজ। বাংলাদেশ পেশাদার লিগে মাঠ কাঁপানো স্ট্রাইকার আরিফ হাওলাদার ফুটবল মাঠে সফল হলেও এই করোনাকালে জীবনযুদ্ধে বড় অসহায়।
দেশের স্বনামধন্য ক্লাবে বছরে ৬ লাখ টাকার পারিশ্রমিকে খেলা স্ট্রাইকার আরিফ এখন ৪০০ টাকার জোগালি।
বাংলাদেশ প্রতিদিনে শনিবার স্ট্রাইকার আরিফ হাওলাদারের জীবনের করুন পরিণতির সংবাদ প্রকাশে পাওয়ার পর ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। শনিবার দুপুরে এই প্রতিবেদন পড়ে আরিফের প্রতি আর্থিক সহায়তার হাত বাঁড়িয়ে দিয়েছেন এমপি শামীম ওসমান পতœী লিপি ওসমান। আরিফের জোগালি কাজ ছেড়ে দিতে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমান পতœী জেলা মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান সালমা ওসমান লিপি ৫০ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করেছেন। এছাড়া আরিফের খবর নিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক তানভীর আহমেদ টিটু।
শামীম ওসমান পতœী লিপি ওসমান জানান, বিষয়টি আমাদের জন্য শিক্ষণীয় যে আরিফ কারো কাছে হাত না পেতে বাবা বা পরিবার চালাতে জোগালির কাজ বেছে নিয়েছে। এমন সন্তান জাতির জন্য গর্বের। আজকে যেখানে বিভিন্ন স্থানে খবর পাওয়া যায় বৃদ্ধ বাবাকে কিছু সন্তানরা রাস্তায় ফেলে যাচ্ছে, সেখানে আরিফ বাবা মায়ের জন্য জোগালি করতে দ্বিধাবোধ করেনি। তাকে সম্মান জানাই।
তিনি আরও জানান, ওর জন্য ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি এটা প্রচারের জন্য নয়। আল্লাহ যেন এই অনুদানকে কবুল করেন। ইতোমধ্যে ওর জন্য এমপি শামীম ওসমান একটি ফুটবল ক্লাব যোগাড় অথবা একটি চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমি সবাইকে আহ্বান জানাব এ রকম একটি ব্যক্তিত্ববান ছেলের পাশে দাঁড়াতে।
এ বিষয়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক তানভ্রী আহমেদ টিটু জানান, আমরা আরিফের পরিবারের খোঁজ নিয়েছি। ঘটনাটি সত্যিই আমাদের ব্যথিত করেছে। আমরা আরিফের জন্য দীর্ঘস্থায়ী কিছু করার চেষ্টা করছি।
প্রসঙ্গত, কারোনাকালে স্ট্রাইকার আরিফকে কোন টিম নেয়নি। আরিফ অতীতে ফুটবল খেলে যে টাকা কামিয়েছিল সেই টাকা দিয়ে বাবাকে দিয়েছিল ব্যবসা করতে। কিন্তু লোকসান হওয়ায় পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। বাবা স্ট্রোক করে দুই বার। ২০১৯ সালে আড়াই লাখ টাকা বাৎসরিক চুক্তিতে চ্যাম্পিয়নস লিগ অগ্রণী ব্যাংক, ২০১৭-১৮ মৌসুম শেখ জামাল টিমে ৬ লাখ, ২০১৬ সাল ৩ লাখ টাকা আরামবাগ কেসি ও ২০১৫ বি লিগ বিজেএমসিতে আড়াই লাখ টাকা চুক্তিতে টিমে সুযোগ পায় আরিফ। কিন্তু পরে কোন টিমে ডাক না পেয়ে তার জীবনে নেমে আসে বেকারত্ব। বাবা মায়ের সংসার টানতে পেটের ক্ষুধা মেটাতে শেষ পর্যন্ত গত দেড় মাস ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে মাত্র ৪শ টাকার জোগালি কাজ করছিল স্ট্রাইকার আরিফ হাওলাদার। কিন্তু সেলিব্রেটি খেলোয়াড়ের এ আত্মত্যাগ কি আর গোপন থাকে? এক কান দু’কান করে আরিফের জোগালি কর্মের ভিডিও চলে আসে বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদকের হাতে। শুক্রবার বাদ জুম্মা নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লার গাবতলীর বাসিন্দা আরিফ হাওলাদারকে শহরের গলাচিপা চেয়ারম্যান বাড়ির নির্মাণাধীন বাড়ি থেকে জোগালির কাজ করা অবস্থায় পাওয়া যায়। ওই সময় নিজের জীবনে দুর্দশার কথা জানিয়ে লজ্জায় কাউকে বলতে পারেনি বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আরিফ। তাৎক্ষণিক আরিফকে জোগালির কাজ থেকে ফিরিয়ে আনেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের এই প্রতিবেদক।
শুক্রবার বাদ জুম্মা আরিফ হাওলাদার বাংলাদেশ প্রতিদিনের এই প্রতিবেদককে বলেন, করোনাকালে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি । ৬ লাখ টাকা বাৎসরিক চুক্তি ছিল শেখ জামাল টিমে। যা টাকা কামিয়েছিলাম বাবাকে দিয়েছিলাম ব্যবসা করতে। বাবা পরিবহন ব্যবসা করে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে প্রায় সব টাকা খুইয়ে ফেলেন। এর মধ্যে এই কারোনাকালে আমাকে কোন টিম চুক্তিতে নেয়নি। ২০১৯ সালে ঢাকা চ্যাম্পিয়নস লিগে অগ্রণী ব্যাংকে বাৎসরিক ৩ লাখ চুক্তিতে খেলতে থাকি। কিন্তু ২০২০ সালের কোন লিগের টিম ডাকেনি। এতে বেকার হয়ে যাই। টিম না পাওয়ার কারণে আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে আমার বাবা দুই বার স্ট্রোক করেছেন। বাসা ভাড়ার জন্য বাড়িওয়ালা খারাপ ব্যবহার ও অন্যদিকে ঘরে অভাব। সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নেই কারো কাছে হাত পাতব না। নেমে পড়ি জোগালি কাজে। গত দেড় মাস যাবত কাজ করে যাচ্ছি। বাসার কেউ জানত না আমি জোগালি কাজ করছি। কোন সময় এই কাজ করিনি বলে পা কেটে গেছে। কিন্তু আর গোপন রাখতে পারলাম না। অনেককে নানা কৌশলে নিজের সমস্যার কথা জানিয়েছিলাম। হয়ত কেউ উপলব্ধি করতে পারেনি। আর লজ্জায় ভেবেছি কারো কাছে হাত পাতার চেয়ে খেটে খাওয়া ভালো। মাত্র ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি।
বিকালে আরিফের গাবতলী খানকা শরীফ বাড়িতে গেলে আরিফের জোগালি জীবনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আরিফের মা মফিজা বেগম বলেন, সংসারে অভাব মেটাতে আমার ছেলেটা জোগালি কাজ করছে আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। কিন্তু ওর পায়ে কাটা ছেড়া ও শরীর ব্যাথা কথা শুনে সন্দেহ হয়। পরে এলাকার অনেক মানুষ জানায় আমার ছেলে আমাদের সংসারের অভাব মেটাতে জোগালি কাজ করছে। এই বলেই সেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন।
আরিফ আরও জানায়, আমি বেঁচে থাকতে আমার বাবা-মা না খেয়ে থাকবে তা হতে পারে না। আমি খেঁটে খেতে চাই। আমি আমার যোগ্যতা প্রমাণ করে ফুটবলে ফিরতে চাই। আমাকে এমপি শামীম ওসমানের স্ত্রী আর্থিক অনুদান পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমি দীর্ঘস্থায়ী হয়ে ফুটবলে ফিরতে চাই।
আরিফের বাবা শাজাহাজন হাওলাদর জানান, জাতীয় অনুর্ধ্ব ১৩, ১৪, ১৬ কিশোর থেকেই ফুটবলে সুযোগ পেয়েছিল আরিফ। ওর যা পুঁজি ছিল আমি ব্যবসা করতে গিয়ে খুইয়ে ফেলেছি। আমি গর্বিত আমার সন্তান নিয়ে যে সে কারো কাছে হাত পাতেনি। কর্ম করে সংসারের অভাব মেটানোর চেষ্টা করছে।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন