উন্নতমানের প্রতিশব্দ থাকা স্বত্বেও মিডিয়াতে কিছু শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে যা শুনতে না শ্রুতি মধুর, না উন্নতমানের। যেমন- পুত্রের স্থলে “ছেলে” লিখা বা বলা হচ্ছে। পিতার স্থলে “বাবা” শব্দটি ব্যবহ্নত হচ্ছে। কেহ মৃত্যুবরণ করলে “ইন্তেকাল” বা “শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ” বা মৃত্যুবরণ” করেছেন এর পরিবর্তে প্রয়োগ হচ্ছে “মারা” গেছেন। “মারা” যাওয়ার পরিবর্তে “ইন্তেকাল” বা “শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ” বা “মৃত্যুবরন” শব্দগুলি নিশ্চয় “মরা” শব্দের চেয়ে উন্নতমানের, সুশোভন ও শ্রুতি মধুর। “ইন্তেকাল” শব্দটি ব্যবহারে কোলকাতা মনস্ক বুদ্দিজীবিদের আতে ঘা লাগতে পারে এ জন্য যে তারা “ইন্তেকাল” শব্দে হয়তো সাম্প্রদায়িকতার অহেতুক গন্ধ খুজে পাবেন, সেক্ষেত্রে “মারা যাওয়া” শব্দটি ব্যবহার না করে “মৃত্যুবরণ” বা “শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ” শব্দগুলি ব্যবহার বেশী অর্থপূর্ণ ও শ্রুতি মধুর। শাব্দিক ব্যবহার সম্পর্কেও কোন কোন সময় মিডিয়াকে উদাসীন মনে হয়। যেমন- একটি বহুল প্রচারিত ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার স্কলের ফুট নোটে লেখা দেখলাম “মেজর সিনহার “মারা” যাওয়ার ঘটনায় তিনজন গ্রেফতার”। মিডিয়ার শাব্দিক প্রয়োগ অর্থপূর্ণ হতে হবে। কেহ যদি খুন হয় সেখানে “নিহত” শব্দটি প্রয়োগ করতে হবে, “মরা” শব্দটি সে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অর্থহীন এবং এপ্রোপ্রিয়েট শব্দ প্রয়োগে উদাসীনতার পরিচায়ক। মিডিয়া এক অর্থে গোটা পৃথিবীতে বিভিন্ন বিষয়ে প্রভান্বিত করার এখতিয়ার অর্জন করেছে। সে ক্ষেত্রে “শব্দ” প্রয়োগে মিডিয়া যদি উদাসীন হয় তবে ভাষা সম্মৃদ্দশালী হতে বাধাগ্রস্থ হবে। এ ধরনের আরো অনেক উপমা দেয়া যাবে যেখানে উন্নতমানের এপ্রোপ্রিয়েট প্রতি শব্দ থাকা স্বত্বেও নিম্নমানের শব্দ মিডিয়াতে অহরহ ব্যবহ্নত হচ্ছে।
শব্দ শ্রুতিমধুর হওয়ার তাৎপর্য অনেক। যে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম শ্রুতিমধুর নহে, সেগুলি পরিবর্তনের জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নেত্রকোনা জেলাধীন পূর্বধলা উপজেলার একটি স্কুলের নাম “চোরের ভিটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়”। নীলফামারী সদর উপজেলার “মানুষমরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়” এর নাম পরিবর্তন করে “মানুষ গড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়” নাম করণ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন পরে হলেও সরকার শ্রুতি মধুর নাম রাখার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা একটি যথাপোযুক্ত সিদ্ধান্ত বটে। উল্লেখ্য “মানুষ মরা” নামের চেয়ে “মানুষ গড়া” শব্দটি অনেক শ্রুতি মধুর, তাৎপর্যপূর্ণ এবং অর্থ বোধক। অন্যদিকে ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে “মরা” জাতীয় শব্দ শুশোভন নয় জেনেও মিডিয়া অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করছে। এটা কি সঠিক ভাষা প্রয়োগে অলসতা, নাকি ভাষা জ্ঞানের ঘাটতি? উল্লেখ্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) এক সার্কুলারে যে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম শ্রুতিমধুর নহে তা আগামী ৩০/৮/২০২০ ইং তারিখের মধ্যে পরিবর্তনের জন্য নির্দেশনা জারী করেছেন। এ ধরনের প্রস্তাব ইতোপূর্বেই বাংলা একাডেমী থোক দেয়া উচিৎ ছিল, কিন্তু কর্তৃপক্ষ যেখানে সরকারকে খুশী রাখার জন্য ব্যতিব্যস্ত সেখানে এ ধরনের সংস্কারমূলক কাজে তাদের সময় কোথায়?
বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃ ভাষা। এ মাতৃ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে রক্ত ঝরাতে হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রভাষা হিসাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেও প্রয়োগ গতভাবে এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা এখনো রাষ্ট্রভাষা হিসাবে পরিপূর্ণতা লাভ করে নাই। অথচ বাঙ্গালীর ভাষা আন্দোলনের প্রতি বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়েছে, ২১শে ফেব্রুয়ারী “আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস” হিসাবে পালিত হচ্ছে।
আসামে ভাষার স্বীকৃতির দাবীতে আন্দোলন হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানেও নিজ মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার জন্য আন্দোলন করেছে, কিন্তু বাঙ্গালীর ভাষা আন্দোলনই আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ফলে এটাই বলা বাহুল্য যে, বাংলা এখন অন্যতম আন্তর্জাতিক ভাষা। এ কারণেই ভাষাটির মর্যাদা বৃদ্ধি, সুশোভন করে প্রসারিত করা প্রতিটি বাঙ্গালীর দায়িত্ব ও কর্তব্য, মিডিয়ার দায়িত্ব আরও বেশী।
ভাষার উন্নয়ন ও প্রয়োগ যথাযথ হচ্ছে কি না তা দেখার দায়িত্ব যে প্রতিষ্ঠানটির তার নাম বাংলা একাডেমী। ১৯৫২’র মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৪’র জাতীয় নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর ফ্রন্টের ২১ দফার ষষ্ঠদশ দফার বাস্তবায়ন হিসাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষনা-বিকাশের লক্ষে ১৯৫৫’র ৩রা ডিসেম্বর বর্ধমান হাউসে বাংলা একাডেমীর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় বর্ধমান হাউসে পূর্বপাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের বাস ভবন ছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অসমাপ্ত বিচার কার্য এ বর্ধমান হাউসেই হয়ে ছিল, জনতার রোশানলে বিচারক আব্দুর রহমান তখন পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান। ঐতিহাসিক দিক থেকেও ভবনটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দল মত নির্বিশেষে জাতীয় মতামতকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বা সকল পথ ও মতের মানুষ যেন একটি জায়গায় বসতে পারে এ ধরনের একটি “প্লাটফর্ম” জাতীয়ভাবে থাকা দরকার, যা অন্যান্য রাষ্ট্রেও রয়েছে। “বাংলা একাডেমী” সর্বজন গ্রহণযোগ্য ধরনের একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিনত হতে পারতো, যা বাংলাদেশের সকল পথ ও মতের কবি, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্দিজীবিদের গ্রহণযোগ্য একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলা যেতো। কিন্তু দিনে দিনে “বাংলা একাডেমী” একটি দলীয় প্লাট ফর্মে পরিনত হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টী, জামাতে ইসলামী সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অফিসের মতই বাংলা একাডেমী সরকারের একটি রাজনৈতিক অফিস হিসাবেই ব্যবহ্নত হচ্ছে। একাডেমী পরিচালনার জন্য একাডেমী সদস্যদের নির্বাচিত কোন কমিটি নাই, সরকারী ঘরনার একজন বুদ্দিজীবি একাডেমীর সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন আমৃত্যু। কমিটির অন্যান্য সদস্যরাও সরকারী ঘরনা থেকে নিয়োগ প্রাপ্ত। ফলে ভিন্ন মতাবলম্বীদের এখানে প্রবেশের কোন সূযোগ নাই। একাডেমী অনেক বই প্রকাশ করেছে, কিন্তু ভিন্ন মতাবলম্বীদের বই প্রকাশ করে না। লেখক হিসাবে পুরুষ্কার বা স্বীকৃতি প্রদান বা ফেলোশীপ প্রদানের ক্ষেত্রেও শুধুমাত্র সরকারী ঘরনার লেখকদের গুরুত্ব দেয়া হয়। ভিন্ন মতালম্বীরা উন্নতমানের বই লিখলে বা গবেষণা করলেও স্বীকৃতি নাই, সহযোগীতা করা তো অনেক দূরের কথা।
একটি দেশকে ধ্বংস করার জন্য সে দেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে পারলেই জাতিটি ধ্বংসের দাড়প্রান্তে পৌছে যায়। তখন যুদ্ধ করে পতন ঘটানোর প্রয়োজন হয় না। ফলে একটি জাতিস্বত্বাকে পরিপূর্ণতায় পরিনত করার জন্য জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে প্রটেকশন দিতে হবে। নতুবা অপসংস্কৃতি বা পশ্চিমা সংস্কৃতি প্রবেশ করে জাতীয় সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করবে, যা ইতোমধ্যে অনেকটুকু দখল করে ফেলছে। বাংলার ঐতিহ্যকে লালন পালনের চেয়ে ওয়েষ্টার্ন সংস্কৃতির প্রতি সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মানুষেরা ঝুকে পড়েছে। বাংলা নব বর্ষকে যথাযথ মর্যাদা উৎযাপনের চেয়ে টাকা ওয়ালা লোকেরা ও তাদের উঠতি বয়সের সন্তানেরা থাটিফাষ্ট নাইট বেশী ঘটা করে পালন করে। পশ্চিমা সংস্কৃতি যাতে জাতিগতভাবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি অংগনের অংশ হতে না পারে এজন্য বাংলা একাডেমীর যতটুকু গুরু দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল ততটুকু তারা করে না। তারা শুধু তাদের পছন্দনীয় সরকারী ঘরনার লোকদের পৃষ্ঠপোষকতা করে।
গ্রাম গঞ্জের এখনো অনেক বাউল, মুর্শীদি, নানা ধরনের উৎসব পালন করা হচ্ছে, কোথাও পৃষ্ঠপোষকতা তথা অভাবের কারণে হারিয়ে গেছে সেগুলি জাতীয়ভাবে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করা হচ্ছে কি না বা করলে কতটুকু সংগ্রহ করা হচ্ছে তাহাও জাতি জানতে পারে নাই, কারণ বাংলা একাডেমী তাদের হাত দেশব্যাপী বিকৃত করতে পারে নাই।
স্বাধীনতার পর দেশকে নিরক্ষর মুক্ত করার জন্য সরকারী ভাবে একটি উদ্দ্যেগের কথা বলা হলেও পরবর্তীতে ক্ষমতাহীন সকল সরকারের ম্যানুফেষ্টুতে “দেশ নিরক্ষর মুক্ত” করার ঘোষনা থাকলেও তা আর বাস্তবায়িত হয় নাই। সরকারের “গণ শিক্ষা” কার্যক্রম নামে একটি দপ্তর থাকলেও এর কোন ভূমিকা জনগণ দেখতে পায় না। একটি রাষ্ট্র তথা জাতিকে প্রতিযোগীতামূলক এ বিশ্বে মাথা উচু করে টিকে থাকার জন্যই সকল স্তরে মানসিক প্রস্তুতি ও সেমতে অগ্রগামী হওয়া দরকার।
গোটা বিশ্বে অনেক রাষ্ট্র যেখানে চাদে তাদের জাতীয় পতাকা রেখেছে, অন্যান্য গ্রহে যাওয়ার পদক্ষেপ নিচ্ছে সেখানে আমরা বালিশ ক্রয়ের খরচ বাড়িয়ে কি ভাবে টাকা আত্মসাৎ করা যায়, কি ভাবে ত্রাণের চাউল কালোবাজারে বিক্রি করা যায়, কি ভাবে জ্বাল টাকা বানানো যায়, পুলিশে চাকুরীরত অবস্থায় কি ভাবে মানুষ খুন ও চাদাবাজী করা যায়, করোনার নেগেটিভ ভূয়া সার্টিফিকেট দিয়ে অজস্র অর্থ উপার্জন করা যায়, ক্ষমতাসীনের নেতা হয়ে কি ভাবে জাতিকে শোষন শাসন করা যায় প্রভৃতি অপকর্ম ও সমাজ বিরোধী কর্মে লিপ্ত যা করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অপব্যবহার। রাষ্ট্র নিজেও দলবাজীতে নিমগ্ন থাকায় চোরেরা মহাচোরে এবং বাটপাররা মহা বাটপারে পরিনত হয়েছে এবং যেহেতু আমাদের জাতিস্বত্বা এখনো গড়ে উঠে নাই, তথা দেশ প্রেমে সমগ্র জাতি উৎবুদ্দ হয় নাই বলে গোটা জাতি আজ আপোষ কামিতায়। ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়, অপব্যবহার এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুষম বন্টনের নীতিমালা বর্হিভূত ও পরিপন্থী কর্মকান্ড অবাধে হচ্ছে, যা বন্ধ করার জন্য দেশ প্রেমে উৎবদ্ধ একটি জাতিস্বত্বা দরকার।
লেখক: অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার
জীবন সদস্য, বাংলা একাডেমী
সদস্য, এশিয়াটিক সোসাইটী
সাবেক সিনেটর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়