বিস্মিল্লাহির রাহ্মানির রাহিম। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল তার রাষ্ট্রীয় পরিচিতি “গণপ্রজাতন্ত্রী” এবং ১৯৭২ ইং সালে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে সংবিধান প্রনীত হয় তার পরিচিতি “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান।” রাষ্ট্রীয় ভাবে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও এর বর্তমান অবস্থান কোথায় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষকদের মতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে তারা কি মতামত পোষন করেন এ মর্মে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষনা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হার্ডসের মন্তব্য থেকে আচ করা যায়। ফ্রিডম হাউস যে মন্তব্য করেছে তা নিম্নরূপ ঃ-
“টানা ১৩ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা কমছে। এ থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশও। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের বিবেচনায় এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর আগের বছরের তুলনায় কমেছে ৪ পয়েন্ট। ডেমোক্র্যাসি ইন রিট্রিট: ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০১৯ শীর্ষক প্রতিবেদনটি গত সোমবার প্রকাশ করেছে ফ্রিডম হাউস। এতে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ১০০ (সবচেয়ে ভালো) এর মধ্যে ৪১। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে ছিল ৪৫। তার আগের বছর ৪৭। ১৯৫টি দেশ ও ১৪ অঞ্চলের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকার এ দুটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার স্কোর নির্ণয় করা হয়েছে। ৪১ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ আছে আংশিক মুক্ত দেশের কাতারে। আগের দুই বছরও একই ক্যাটাগরিতে ছিল বাংলাদেশ। অপর দুটি ক্যাটাগরি হলো যুক্ত ও মুক্ত নয়। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়ন ও ভয়ভীতি দেখায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভোটের দিনও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ এবং বিভিন্ন দলের মধ্যে সংঘাতের তথ্য এসেছে, ডজনখানেক লোকের প্রাণ গেছে সহিংসহায়। ১০০ এর মধ্যে ১০০ স্কোর নিয়ে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে তিন দেশ ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও সুইডেন। বিপরীত দিকে একেবারে তলানিতে আছে সিরিয়া। দেশটির স্কোর শুন্য ” (সূত্র: জাতীয় পত্রিকা ০৭/০২/২০১৯ ইং)।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং জাতীয় নির্বাচন-২০১৮ নিয়ে শুধু আন্তর্জাতিক গবেষনামূলক সংগঠন থেকে নয় বরং বাংলাদেশের বুদ্দিজীবি সমাজ যারা সরকারের পক্ষেই একসময় সাফাই গাইতেন তারাও এখন নির্বাচনের অনিয়ম সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছেন। ইংরেজী জাতীয় দৈনিকের একটি অন-লাইন পত্রিকায় ০৬/০২/২০১৯ ইং তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, “জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তো প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন কেন উঠলো সেটিই আমার প্রশ্ন। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময়ই বলেছেন তিনি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চান না। সেই ক্ষেত্রে প্রশ্ন কেন উঠলো? এটি শুধু বিএনপি বা ঐক্যজোটের প্রশ্ন নয়, দেশের ভেতরে-বাইরে থেকে এই প্রশ্ন উঠেছে। যেমন, জাসদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শরিকদল। তারাও তো প্রশ্ন তুলেছে। কাজেই অন্যকোনো নির্বাচন এ ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ হোক সেটি আমরা চাই না। নির্বাচন নির্বাচনের মতোই হোক।” এ বিষয়ে ১/১১ সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের মন্তব্য, “তিনি (সিইসি) যদি তার অবস্থান থেকে মনে করেন গত জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে এবং তিনি যদি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চান তা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যে, বিগত জাতীয় নির্বাচনে বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধুমাত্র সরকার পক্ষ ও সরকার সমর্থকদের কাছ থেকে শোনা গেছে কোনো রকম অনিয়ম হয়নি। কিন্তু এর বাইরে যেকোনো ব্যক্তির সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছি, কিংবা আমাদের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র প্রতিবেদন করতে গিয়ে যখন গবেষণা করতে গিয়েছি তখন বিভিন্ন সূত্র থেকে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ এসেছে।”
বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে জলাঞ্জলি দেয়ার জন্য কাগজে কলমে স্বাধীন সাংবিধানীক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা যারা শপথ গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের অধিকার রক্ষায় দায়িত্ব নিয়েছেন তারাই জল্লাদের ভূমিকা পালন করেছেন। কোন সাংবিধানিক স্বাধীন নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান নিরপেক্ষ ভাবে দায়িত্ব পালন করেন নাই। বরং জনগণের অধিকারকে কি ভাবে ক্ষুন্ন করা যায় তারই নীল নকশা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ এবং সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছেন। ব্যতিক্রম যারা ছিলেন তারা ধোপে টিকে নাই। ভোটার বিহীন একটি নির্বাচন করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে দেশব্যাপী গায়েবী মামলা দিয়ে জনগণকে নজীর বিহীন হয়রানী করা হয়েছে যার বিবরণ প্রতিনিয়তই মিডিয়াতে প্রকাশ পেয়েছে কিন্তু সে হয়রানীর প্রতিকার কোথাও পাওয়া যায় নাই। উল্লেখ্য, “ধান বেচে জামিন নিতে ঢাকায়” শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকে ০৭/০২/২০১৯ ইং তারিখে একটি সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যা পাঠ করলেই দেশব্যাপী গায়েবী মামলার শিকড় কতটুকু গড়িয়েছে তা অনুধাবন করা যায়। সংবাদটি নিম্নে হুবুহু তুলে ধরা হলো ঃ-
“পাঁচ শ টাকা মণে আমন ধান বেচে মামলার আগাম জামিন নিতে ঢাকা এসে ২০ টাকা প্লেট ভাত খেতে হয়েছে। তাতেই মেজাজ গরম ফজল খানের। হিসাব কষছিলেন এক জামিনে কয় মণ ধান গেল। সত্তরের কোঠায় বয়স এই কৃষকের বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। নির্বাচনের আগে নাশকতার মামলায় আসামি করা হয় তাঁকে। নির্বাচনের দিন জেনেছেন মামলার খবর। ফজল খান বলেন, সবই গায়েবি মামলা। আমার বাড়ি থেকে কয়েক মাইল দূরের ঘটনা সব। কেন মামলা দিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, জমির আইল নিয়া ঝামেলা ছিল, আর কোনো ঝামেলা তো মনে করতে পারি না। আমরা তো পার্টিও করি না। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার ৭০ জনের দলটির সঙ্গে ছিলেন ফজল খান। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থানায় হওয়া মামলাটিতে মোট আসামি ১০৫। মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে কাগজের নৌকা প্রতীক ও পোষ্টার পোড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামিদের সবাই কৃষক, দিনমজুর, শ্রমিক বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। কয়েকজন কোনো টাকা দেননি, বাকিরা এক থেকে তিন হাজার করে টাকা দিয়েছেন আইনজীবীর খরচ হিসেবে। প্রতি ১০ জনের এক ফাইলে আইনজীবী পাঁচ হাজার করে টাকা নিয়েছেন। আছে যাতায়াতের খরচও। ফজল খানের হিসাবে অন্তত সাত মণ ধানের দাম বেরিয়ে গেল এক মামলার জামিন নিতে এসে। তিনি বলেন, চাষে আর লাভ হয় না। বীজ-সার-পানি দিতে কাঠাপ্রতি দুই হাজার ছয় শ টাকা খরচ হয়। এবার আমনের দরও ভালো, মণপ্রতি পাঁচ শ টাকা। এই দরে এক কাঠা জমিতে (ওই এলাকায় ১০ শতাংশে এক কাঠা) আড়াই হাজার টাকার ধান পাওয়া যায়। কাঠাপ্রতি এক শ টাকা লোকসান। তার ওপর মামলায় অনেকগুলো টাকা বেরিয়ে গেল। খেতে আউশ ধান লাগানোর প্রস্তুতি ফেলে আসতে হয়েছে। তবে জামিনের জন্য একটি টাকাও দিতে পারেননি সবুজ মিয়া। দিনমজুর সবুজ মিয়া দলের একটু বাইরে হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনের হাঁটাপথে প্লাষ্টিকের স্যান্ডেলের ওপর বসে ছিলেন। বয়স আনুমানিক ৫৫। তবে কাঁচা-পাকা চুল-দাড়িতে আরও বয়স্ক লাগে। হাতের ১০টি আঙুলই ক্ষয়ে কালো হয়ে গেছে, কয়েকটি দাঁতও নেই। কী মামলা জিজ্ঞেস করতেই ফোকলা দাঁতে হেসে সবুজ-বলেন, দিছে একটা! আমি কিছু বুজি না। গ্রামের লোকে কইল আসামি করছে, জামিন নিতে অইব। আমি কাইজ-কাম থুইয়া আইলাম। অন্যের বাড়িত কাম করি। আমি তো কাউরে কুনো ট্যাকাও দিতে পারি নাই। হাতের ক্ষয়ে যাওয়া নখ দেখিয়ে বলেন, খেত আর গোয়ালঘরে কাজ করতে করতে হাতের আঙুল ক্ষয়ে গেছে। নেত্রকোনার দলটির মতো ব্রাক্ষ¥ণবাড়িয়ার সদর থানা ও বিজয়নগর, বগুড়ার সোনাতলা, নোয়াখালীর চরজব্বর থেকে আরও প্রায় তিন শ লোক এসেছিলেন। ব্রাক্ষ¥ণবাড়িয়া সদর থানার তিনটি মামলায় জামিন নিতে এসেছিলেন ১৫২ জন। তাঁদের কয়েকজন জানান, তাঁরা প্রায় সবাই বিএনপির রাজনীতি বা যাঁরা বিএনপি করেন, তাঁদের সঙ্গে যুক্ত। নির্বাচনে ধানের শীষের এজেন্ট হওয়ার কথা ছিল তাঁদের। আগের দিনই থানা থেকে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, ভোটকেন্দ্রে এলেই গ্রেপ্তার করা হবে। তবে ব্রাক্ষ¥ণবাড়িয়ার বিজয়নগর থেকে আসা কৃষক রফিকুল ইসলাম, সামাদ মিয়ারা জানালেন, তাঁরা কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। তাঁদেরও মামলায় জড়ানো হয়েছে।”
জাতীয় নির্বাচন ২০১৮ একটি ভোট বিহীন নির্বাচন করে সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করে নাই বরং প্রতিধন্ধীতা বিহীন একটি নির্বাচনী সংস্কৃতি চালু করেছে। এ ব্যবস্থা কারণে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলি সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এখন আর মানুষ নির্ভয়ে প্রতিধন্ধীতা করতে এগিয়ে আসতে চাইবে না। স্থানীয় সরকার দলীয় মার্কায় নির্বাচন হওয়ায় সরকারী মার্কা প্রাপ্ত প্রার্থীকে পাস করানোর জন্যই পুলিশ প্রশাসন ব্যতিব্যস্থ থাকার কথা সরকার সমর্থীত এবং বাম দলগুলির পক্ষ থেকে আওয়াজ উঠেছে। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পুর্ননির্বাচনের দাবিতে জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে ১১/০২/২০১৯ ইং তারিখে সাংবাদিক সম্বেলনে বাম জোট নেতা সাইফুল হক বলেন, “৩০ ডিসেম্বরের অভূতপূর্ব ভোট জালিয়াতির পর নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনি ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনও জাতীয় নির্বাচনের মতো অর্থহীন ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সরকারের শরিকরাও এ কারণে এসব নির্বাচনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। তিনি বলেন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করছে। এই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়া হলো।”
প্রতিদন্ধীতা বিহীন যে নির্বাচনী সংস্কৃতি চালু হয়েছে জাতীয় ঐক্য মতের ভিত্তিতে তা প্রতিরোধ করা না হলে স্বাধীনতার চেতনা বা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অর্থাৎ “গণতন্ত্র (সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং-৮) দিনে দিনে ধূলিস্যাতের জন্য জাতিকে আর বেশী দিন অপেক্ষা করতে হবে না। কারণ একদলীয় শাসন ব্যবস্থা এমনিতেই চালু হয়ে গেছে, বাকী শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা।
বিঃ দ্রঃ কলামিষ্ট তৈমূর আলম খন্দকার প্রনীত “মিথ্যার কাছে জাতি পরাজিত” এবং “নিশি রাত্রির দ্বিপ্রহর” একুশে গ্রন্থ মেলা-২০১৯ এ প্রকাশিত হচ্ছে। তাছাড়া পূর্বে লেখক প্রনীত “মীরজাফর যুগে যুগে” “সময়-অসময়” ও “রাজনীতির ভগ্নাংশ” একুশে গ্রন্থ মেলার ৫৬২নং ষ্টলে পাওয়া যাবে।
লেখক: অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার
কলামিষ্ট ও আইনজীবি (এ্যাপিলেট ডিভিশন)
বিঃদ্রিঃ এই লেখা লেখকের ব্যক্তিগত মতামত যা অনলাইন পোর্টাল ‘ সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম’ এর নয়।