সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিতর্কের যেনো শেষই হচ্ছে না। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এমন সব কর্মকাণ্ড যা রীতিমতো নেটদুনিয়া সহ দেশবাসীর মাঝেও সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আচরণ ও বক্তব্যের ভাষায় বুঝা যাচ্ছে তারা অনেকটা বেসামাল ও টালমাতাল অবস্থায় বক্তব্য দিচ্ছেন। যে কারনে কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীকেও গোনায় ধরছেন না, আবার কোনো কোনো সংগঠনের নেতা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অবজ্ঞা করে বক্তব্য রাখছেন। আবার কেউ কেউ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েই স্থানীয় আওয়ামী লীগের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রকাশ্য সমালোচনা করছেন।
মূলত গত বছর সোনারগাঁও রয়েল রিসোর্ট কেন্দ্রীয় হেফাজতে ইসলামের সাবেক নেতা মাওলানা মামুনুল হকের নারী কেলেঙ্কারি ও হেফাজতের তান্ডবের ঘটনায় স্থানীয় জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়ে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের দমিয়ে বিভিন্ন সেক্টর নিয়ন্ত্রণ টেন্ডারবাজি চাঁদাবাজি ফুটপাত দখল নিয়ে নিজেদের মধ্যে দখলের একটা প্রতিযোগিতা শুরু করেছেন আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীরা। এইসব নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধের জের ধরেই একে অপরকে দমাতে নিজেদেরকে অনেক বড় মাপের কিছু জাহির করার চেষ্টা করতে গিয়ে নানা ধরনের বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা।
স্থানীয়রা দাবি করেন, জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা যখন হেফাজতের মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় আসামি হয়ে সোনারগাঁ ছাড়া, তখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হালুয়া-রুটির ভাগ বসাতে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি শুরু করেছেন। যেখানে ঘটনা শুরু গত বছরে মহান স্বাধীনতার স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস পালনে আওয়ামী লীগের একটি অংশের সমাবেশ ও প্যান্ডেল ভাংচুর করেছে আওয়ামী লীগের অপর একটি অংশে নেতাকর্মীরা। সেই থেকে শুরু।
২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁও) আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা। ২০১৮ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো এখানে এমপি নির্বাচিত হোন। সান নারায়ণগঞ্জকে অনেকে জানান, এমপি খোকা নির্বাচিত হওয়ার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও সুশীল সমাজকে সাথে নিয়ে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে নেতৃত্বে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড করে আসছিলেন। উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড করতে গিয়ে তিনি একেবারে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যান। তিনি এলাকায় এলাকায় ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধান করেন।
এমন অবস্থায় এমপি খোকা সমাজের সাধারণ মানুষের মাঝে মধ্যমনি হিসেবে অবস্থান তৈরি করে নেন। সোনারগাঁয়ের মানুষ তাকে আমজনতার এমপি হিসেবে মনে করেন। যে বিষয়টি আওয়ামী লীগের নেতাদের জন্য গাত্রদাহ শুরু হয়। বিভিন্ন কৌশল অপকৌশলে এমপি খোকাকে ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। কিন্তু বারবার এমপি খোকা আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে বুকে টেনে নিয়ে আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড করতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন বলেও সান নারায়ণগঞ্জকে অনেকে জানান। যখন এমপি খোকাকে রাজনৈতিকভাবে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাচ্ছিলো না, তখন এমপি খোকা ও জাতীয় পার্টিকে ধমাতে ২০২১ সালের ৩ এপ্রিল সোনারগাঁও রয়েল রিসোর্ট কেন্দ্রীয় হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা মামুনুল হক নারী কেলেঙ্কারির ঘটনায় অবরুদ্ধ হলে এবং হেফাজত নেতাকর্মীদের তাণ্ডবের ঘটনায় সোনারগাঁ থানায় ৭টি মামলা দায়ের করা হয়।
এসব মামলায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জাতীয় পার্টির ওয়ার্ড নেতাকর্মী থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নামে মামলা দেয়া হয়। যদিও মামলাটি তদন্তাধীন তবুও স্থানীয়রা সান নারায়ণগঞ্জের কাছে বলছেন মামুনুল হকের এই তাণ্ডবের ঘটনায় জাতীয় পার্টির কোনো নেতাকর্মী সম্পৃক্ততা নাই। মূলত রাজনৈতিক কারণে জাতীয় পার্টির এমপি ও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের দমাতে, উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করতেই আওয়ামী লীগের একটি অংশের ইন্দনে ওই সব মামলায় জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মী যখন এলাকা ছাড়া তখন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এখন হালুয়া-রুটির ভাগবাটোয়ারা এবং বিভিন্ন সেক্টর নিয়ন্ত্রণে নিজেদের মধ্যে তুমুল বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন।
গত জাতীয় শোক দিবসে সোনারগাঁ পৌর এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর চৌধুরী বিরু অনুগামীরা আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজনে প্যান্ডেল তৈরি করেন। সেখানে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহবায়ক আব্দুল্লাহ আল কায়সার হাসনাত অনুগামী নেতাকর্মীরা সেই প্যান্ডেল ভাঙচুর করেন। আবারও সেখানে প্যান্ডেল তৈরি করলে দ্বিতীয়বার ভাঙচুর করা হয়। এ নিয়ে বিরু অনুগামী এবং কায়সার অনুগামীদের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
এই ঘটনার রেষ ধরেই জেলা পরিষদের সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান মাসুম এক অনুষ্ঠানে অভিযোগ করেন ডাক্তার বিরু ছাত্রজীবনে জামায়েত ইসলামের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের নেতা ছিলেন। এ নিয়ে ডাক্তার বিরুও পাল্টা মামলার হুমকি দেন। দীর্ঘদিন চলে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা ও কাদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতি। এর আগে একই সঙ্গে স্থানীয় জাতীয় সংসদ সদস্য খোকা জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুরো সোনারগাঁও জুড়ে ব্যানার ফেস্টুন সাটান। সেইসব ব্যানার ফেস্টুনগুলো ভেঙে ফেলা হয়।
এদিকে সোনারগাঁ উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদগুলোর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের মাঝেই নানা বিরোধ সৃষ্টি হয়। জয় পরাজয় নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা একে অপরকে দোষারোপ করে নানাভাবে কাদা ছোড়াছুড়ি করেন। নোয়াগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার কয়েকদিনের মাথায় আওয়ামী লীগে যোগদান করেন সামসুল আলম সামসু। আওয়ামী লীগে যোগদানের পর আড়াইহাজার উপজেলায় একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য ও কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন।
১২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে উপজেলার বারদী ইউনিয়ন যুবলীগের এক কর্মীসভায় উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নু উপজেলার দশটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য রাখেন। তিনি অনেকটা হুমকি-ধমকিও দেন। তিনি বলেন, ‘১০টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে এক পাল্লায় রাখলে এবং সোনারগাঁ থানা যুবলীগের সভাপতিকে আরেক পাল্লায় রাখলে থানা যুবলীগের সভাপতির ওজন বাইড়া যাইবো। জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে চিনেন। যুবলীগের নেতাকর্মীদের হুমকি দেওয়া হলে মুখে তালা দিয়া থুমু বইলা দিলাম।’ একই দিন বারদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান বাবুল একটি ওয়াজ মাহফিলে কঠোর বক্তব্য রাখতে গিয়ে এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, আমি বারদীর ম্যাজিস্ট্রেট, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি বারদী আসেন তাহলে আমার হুকুম লাগবে। যদিও এ ঘটনায় বাবুলকে আওয়ামী লীগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এবং বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়।
তবে এই রেষ এখনো কাটেনি। এরই মাঝে ১৬ই ফেব্রুয়ারি উপজেলায় কাইকারটেক হাট ইজারাকে কেন্দ্র করে সোনারগাঁ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নু, মোগরাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফ মাসুদ বাবুর সঙ্গে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি হাজী মোঃ সোহাগ রনি অনুগামী যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মাঝে উপজেলা চত্বরে প্রকাশ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ১৫জন আহত হয়েছেন। সোহাগ রনির লোকজন টেন্ডার ফেলতে গেলে নান্নুর লোকজন হামলা চালায়। এ ঘটনায় সোহাগ রনির অনুগামী আহত সিরাজুল ইসলাম সজল বাদী হয়ে চেয়ারম্যান আরিফ মাসুদ, যুবলীগ সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নু ও জেলা পরিষদের সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান মাসুম সহ ২২জনের নাম উল্লেখ করে ৩০ থেকে ৪০জনের নামে সোনারগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
ওই দিন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এরফান হোসেন দ্বীপের বেশ কয়েকটি ব্যানার ফেস্টুন ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। দ্বীপ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি পোস্টার লাগিয়েছেন। তিনি সাবেক সংসদ সদস্য মোবারক হোসেনের ছেলে। মূলত সম্প্রতি তিনি সোনারগাঁয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পদার্পণ করছেন। যারা বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না, আওয়ামীলীগেরই একটি গ্রুপ, মুলত তারাই তার ফেস্টুন ছিড়েছেন।