ডেস্ক রিপোর্ট:
‘গোলাম রাব্বানী খান শান্তি কমিটির কেউ নয়, রাজাকার ছিলেন না। বরং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরুর প্রাক্কালে মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি ছিলেন। নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের অস্ত্রাগারের চাবি বীর মুক্তিযোদ্ধা খবির আহম্মেদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিউদ্দিন সারোয়ার ওরফে বাবু সারোয়ারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তিনি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান ‘গোলাম রব্বানী খান’। তিনি একজন ভাষা সৈনিক। একজন সফল সাংবাদিকের পাশাপাশি ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব হিসেবেও বিশেষ পরিচিত ছিলেন। গোলাম রাব্বানী নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ১৯৬৪ সালে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের নির্বাচনে কার্য নির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন অধ্যক্ষ শামসুল হুদা। গোলাম রব্বানী ‘দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবেরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি। তার বাবা ‘আবদুস সামাদ খান’ নারায়ণগঞ্জ কোর্টের একজন আইনজীবী ছিলেন। ১৯৫৪ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে ‘এম এল এ’ নির্বাচিত হন সামাদ খান। তবে ওই নির্বাচনে সামাদ খানের প্রতিদ্বন্দ্বীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় গোলাম রব্বানী মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক রসদ সরবরাহ করেন তিনি। স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে তিনি নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের অস্ত্রাগারের চাবি মুক্তিযোদ্ধা খবির উদ্দিন আহমেদ ও শফিউদ্দিন আহমেদ বাবুর কাছে হস্তান্তর করেন। দেশ স্বাধীনের পরেও সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু লেখক মুনতাসির মামুনের লেখা ‘শান্তি কমিটি ১৯৭১’-এ কোন নির্দ্দিষ্ট তথ্য প্রমাণাদি ছাড়াই প্রয়াত গোলাম রব্বানী খানকে শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যার কোন যুক্তি, ভিত্তি ও সত্যতা পাওয়া যায় নাই। মুনতাসির মামুনের বইয়ের বরাত দিয়ে নারায়ণগঞ্জের কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি প্রয়াত গোলাম রব্বানীকে নিয়ে এতদিন অপপ্রচার চালিয়ে আসছিলেন।’
২৪ মার্চ বৃহস্পতিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিটের নেতৃবৃন্দ জেলা প্রশাসনের কাছে প্রয়াত গোলাম রব্বানীর ব্যাপারে একটি প্রত্যয়নপত্র প্রদান করেন। মুক্তিযোদ্ধারা উপরোক্ত বিষয়গুলো দাবি করেন। প্রত্যয়নপত্রে প্রয়াত গোলাম রব্বানী স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী কোন কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন না বলে উল্লেখ করা হয়। উপরন্তু তিনি যুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন বলেও প্রত্যয়নপত্রে উল্লেখ করা হয়।
জেলা প্রশাসককে দেওয়া প্রত্যয়নপত্রে জেলার সদ্য সাবেক কমান্ডার মোহাম্মদ আলী ও সাবেক কমান্ডার সামিউল্লাহ মিলনসহ ৪৭ জন মুক্তিযোদ্ধার স্বাক্ষর রয়েছে। জেলা প্রশাসকের পক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া প্রত্যয়নপত্রটি গ্রহণ করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক (উপ সচিব) ফাতেমা তুল জান্নাত।
প্রশাসনের কাছে প্রয়াত গোলাম রব্বানী সম্পর্কে প্রত্যয়পত্র দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নারায়ণগঞ্জ জেলা ইউনিট কমান্ডের সদ্য সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নারায়ণগঞ্জ জেলা ইউনিট কমান্ডের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সামিউল্লাহ মিলন, বীরমুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকে নুরুল হুদা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নারায়ণগঞ্জ জেলা ইউনিট কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার, বীরমুক্তিযোদ্ধা শাজান ভ্ইুয়া (জুলহাস), মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা জেলা ইউনিট কমান্ডের সদ্য সাবেক কমান্ডার, বীরমুক্তিযোদ্ধা খবির আহেমদ, বীরমুক্তিযোদ্ধা হাজী আবদুল মমিন, বীরমুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকে তারাজ উদ্দিন, বীরমুক্তিযোদ্ধা মোহর আলী চৌধুরী, বীরমুক্তিযোদ্ধা রমিজ উদ্দিন রমু প্রমুখ। জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রত্যয়নপত্রের মাধ্যমে প্রয়াত গোলাম রব্বানী খান সম্পর্কে এতদিন চলা ব্যক্তি বিশেষের প্রচার করা কলঙ্ক থেকে তাকে মুক্তি দেবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এদিকে নিজের বাবাকে নিয়ে অপপ্রচারের বিষয়টি সুরাহার জন্য এবং প্রকৃত সত্য জানতে প্রয়াত গোলাম রব্বানীর বড় ছেলে নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কর্মাসের সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজল বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নারায়ণগঞ্জ জেলা ইউনিট বরাবর গত বছরের ১৬ মার্চ আবেদন করেন। তার ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে গত বছরের ২৪ মার্চ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নারায়ণগঞ্জ জেলা ইউনিট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্স ভবনে একটি সভার আয়োজন করে।
ওই সভায় জেলার সদ্য সাবেক কমান্ডার মোহাম্মদ আলীর সভাপতিত্বে উপস্থিত ৪৭ জন মুক্তিযোদ্ধার কেউই প্রয়াত গোলাম রব্বানী স্বাধীনতা বিরোধী কোন কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন বলে বক্তব্য দেননি। উপরন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন বলে সভায় উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাগণ স্বীকার করেন। শুধু তাই নয় তার বড় ছেলে খালেদ হায়দার খান কাজলও স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি হিসেবে নারায়ণগঞ্জে ভূমিকা রেখে চলছেন এবং নারায়ণগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন কর্মকান্ডের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে তাদের সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে আসছেন।
ওই সভায় উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার সামিউল্লাহ মিলন, জয়নাল আবেদীন টুলু, রমিজ উদ্দিন ও মিজানুর রহমান বাচ্চু প্রয়াত গোলাম রব্বানীর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে রাখা বিভিন্ন ভূমিকার কথা স্মরণ করে তার ঋণ কখনও শোধ হবার নয় বলে উল্লেখ করেন। ওই সভায় মুক্তিযুদ্ধের উপর লিখিত ১০টি বই পর্যালোচনা করে কোথাও স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকান্ডের সঙ্গে প্রয়াত গোলাম রব্বানীর কোন সর্ম্পক পাওয়া যায়নি। ওই সভায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় কর্তৃক প্রকাশিত (পরে স্থগিত) ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা, এশিয়া পাবলিকেশন কর্তৃক ১-৭ খন্ডে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান’, তথ্য মন্ত্রনালয় কর্তৃক ১-১৫ খন্ডে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র’, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক ১-১০ খন্ডে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ’, এমআর আকতার মুকুল কর্তৃক রচিত ‘চরমপত্র’, এএসএম সামসুল আরেফিন কর্তৃক লিখিত, ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান’, শফিক আহমেদ কর্তৃক লিখিত, ‘একাত্তরের দালালেরা’, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত-ডাঃ আহমেদ শরীফ-কাজী নুরুজ্জামান-শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়’, বাংলাদেশ জেনসাইড আর্কাইভ কর্তৃক প্রকাশিত, ‘শান্তি কমিটি’, মুক্তিযুদ্ধ ই আর্কাইভ থেকে জনকন্ঠে প্রকাশিত, ‘সেই রাজাকার’, রীতা ভৌমিক লিখিত, ‘মুক্তিযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ’ পর্যালোচনা করে কোথাও প্রয়াত গোলাম রব্বানী খানের স্বাধীনতা বিরোধী কোন ভূমিকা বা অবস্থানের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের ওই সভায় প্রয়াত গোলাম রব্বানী খানের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট বলে আখ্যায়িত করা হয়।
সূত্র: দৈনিক ডান্ডিবার্তা