রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নারায়ণগঞ্জে লাগামছাড়া কিশোর অপরাধ?

সম্পাদকীয়:
নারায়ণগঞ্জে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে কিশোর গ্যাং। সাম্প্রতিককালে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা বন্দর সোনারগাঁও সহ বেশকটি এলাকায় খুন রাহাজানি মারামারি সন্ত্রাসী কর্মকান্ড আলোচিত হয়ে ওঠেছে কিশোর গ্যাং। ফতুল্লার ইসদাইর এলাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছে এক স্কুল ছাত্র। এর কয়েক মাস পূর্বেও একই এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় একজনের মৃত্যু ঘটে। সবশেষ সোনারগাঁয়ে ছাত্রীদের ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় একজন শিক্ষকের উপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে কিশোর অপরাধীরা।

ভয়াবহভাবে কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। এখন সমাজের অনেক সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিশোর গ্যাং সমস্যা। বিপথগামী কিশোররা এলাকায় মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, চাঁদাবাজি এমনকি হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। কিশোরদের এলাকাভিত্তিক গ্যাংয়ের মধ্যে ঘটছে সহিংসতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব বিপথগামী কিশোরদের আটকের পর আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে স্বজনদের কাছে তুলে দিলেও এর ফল পাওয়া যাচ্ছে খুবই কম। যার ফলে পুলিশ-র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উদ্বিগ্ন।

এদিকে অ্যাপভিত্তিক ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের যোগাযোগ বাড়ায় অপরাধ বেড়েছে আরো বেশি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক সহ টিকটকের ‘কিশোর গ্যাং’গুলো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে দিনকে দিন। করোনার মহামারিতে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকায় এসব অসামাজিক ভিডিওতে লাইক কমেন্ট পাওয়ার জন্য একের পর এক অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোররা।

এছাড়াও বিভিন্ন পার্ক, খোলা জায়গায়, ফুটপাতে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে একত্রিত হয়ে ভিডিও কন্টেন্ট তৈরির নামে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, ইভটিজিং, পথচারীদের গতিরোধ, বাইক মহড়াসহ বিভিন্ন অসৌজন্যমূলক আচরণ করে থাকে।

নারায়ণগঞ্জে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ‘কিশোর গ্যাং’ জেলার প্রায় প্রতিটি পাড়া মহল্লার অলিগলিতে এই কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেপরোয়া। বিশেষ করে ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে কিশোর যুবকরাই এই গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ছে খুন ধর্ষণ সহ নানা অপকর্মে। এদের বেশির ভাগই স্কুলছুট। এরা প্রতিটি এলাকায় মাদক বিস্তারেও কাজ করছে। প্রথমত এদের অভিভাবকদের ছন্নছাড়া অভিভাবকত্ত্বহীনতার কারনে এসব সন্তানেরা কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ছে। এদের সৃষ্টির প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে রাজনৈতিক দলের নেতা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মিছিলে এদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতই।

রাজনৈতিক দলের নেতাদের মিছিল সমাবেশ সফল করেই এরা পাড়া মহল্লায় এসে বেপরোয়া আচরণ করছে। নেতাদের সভা সমাবেশ মিছিল সফল করতে এদের প্রয়োজন। তাই এদের ছত্রছায়াও দিচ্ছেন রাজনৈতিক দলের নেতারাই। মুলত রাজনৈতিক দলের মিছিলের মাধ্যমেই এদের সৃষ্টি। অনেক সময় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এসব কিশোর গ্যাং ব্যবহার করা হচ্ছে। উর্ত্তী বয়সে এসব কিশোর যুবক তরুণদের স্বপ্ন থাকে আকাশচুম্ভিু। এ সময় তাদের রক্ত গরম। তার উপর যদি কোন রাজনৈতিক দলের নেতার ছায়া থাকে তাহলে তারা নিজেকে মহা ক্ষমতাধর মনে করছে না। নিজেকে তামিল সিনেমার হিরোর মতই ভাবতে থাকে। এটা তাদের যে বয়:সন্ধিকাল।

একদিকে যেমন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা তার সমাবেশ মিছিল সফল করতে এদের নিয়ে মিছিলে বড় শোডাউন দিচ্ছেন। আবার অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতারাও রাজপথ গরম করতে এদের হাতে ককটেল সহ নানা আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিচ্ছেন কিনা সেটাও যাচাইয়ের প্রশ্ন। ফলে এরা দুদিকেই ব্যবহৃত হচ্ছে। এদের মধ্য থেকে কখনও কখনও তৈরি হচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী কিংবা খুনি ধর্ষক।

আপনারা দেখবেন- সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন কিংবা সরকারের বাহিরের দলগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলোর মিটিং মিছিল সভা সমাবেশে কতজন ছাত্র অংশগ্রহণ করছে? হাতে গোনা ৮/১০ জন। মিছিলে অংশগ্রহণকারী এদের বেশির ভাগই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। এরা অন্যান্য সংগঠনের কর্মসূচিতেও অংশগ্রহণ করে থাকে। কিশোর গ্যাংয়ের বেশির ভাগ সদস্যরাই মাদকাসক্ত, বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় তারা মাদক ছড়িয়ে দিচ্ছে সহজে। অনেক নেতাদের বাড়ির আশপাশে এরা প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করে আসলেও তাদের দাপটে সাধারণ সচেতন মানুষ মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছে না। কারন এদের শেল্টারদাতা কোন না কোন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা। যে কারনে ওইসব নেতারাও এদের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। কারন কিশোর গ্যাং তাদের প্রয়োজন। তার মিছিল মিটিংয়ে প্রয়োজন।

এমন দৃশ্য শুধু নারায়ণগঞ্জের শহরের এলাকায় নয়। এসব কিশোর গ্যাং জেলার প্রতিটি এলাকায় বিদ্যমান। সোনারগাঁও, আড়াইহাজার, রূপগঞ্জ, বন্দর সহ অন্যান্য এলাকাতেও কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত রয়েছে বেশ। একইভাবে তারাও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতার মিটিং মিছিলে অংশগ্রহণ করে। এরা নেতাদের কথামত কারো জমি দখল করে দেয়, নেতার নির্দেশনায় কাউকে নাজেহাল করছে, নেতার নির্দেশে কাউকে মারধর করছে।

এখন নেতাদের প্রতিজ্ঞা করা উচিত- ছোট ছোট ছেলেদের তার মিছিল মিটিংয়ে প্রয়োজন নেই এবং নিজেদের সমাবেশ মিছিলে মাথা বেশি দেখানোর জন্য এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের নিয়ে তার কর্মসূচি সফল করতে গিয়ে সমাজটাকেই ডুবিয়ে দিচ্ছেন সেটাতেও দৃষ্টি রাখা উচিত। সেই সঙ্গে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া উচিত। পুলিশ বাহিনীকে আরো কঠোর ভুমিকা রাখা উচিত বলে আমি মনে করি। এসব ভবিষৎ প্রজন্ম কারো হাতিয়ার না হয়ে যেনো দেশের সম্পদ হয়ে ওঠতে পারে সেদিকে সকলকে নজর রাখা উচিত।

লেখক: মাজহারুল ইসলাম রোকন
সম্পাদক ও প্রকাশক, সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম