সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:
আগামী ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী দলে পরিনত করতে সারাদেশের মত নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর বিএনপির কমিটিও হতে যাচ্ছে নতুন করে। জেলা ও মহানগর বিএনপির শীর্ষ দুটি পদের নেতৃত্বে রয়েছেন ভারপ্রাপ্ত হিসেবে, যাদের রাজপথে সামনে থেকে নেতৃত্বে দেয়ার মত পারদর্শিতা তেমন একটা নেই বললেই চলে। যার মধ্যে মহানগর বিএনপির অবস্থা একেবারেই নাজুক। সভাপতি নেই বছর খাানিক সময় ধরে দলীয় কর্মসূচিতে। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দিয়ে টেনে হেছড়ে চলছে কর্মসূচি। এমন পরিস্থিতিতে মহানগর বিএনপির সভাপতি পদে অনেকটা নিশ্চিত দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন মহানগর বিএনপির বর্তমান সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান। কিন্তু সাধারণ সম্পাদক পদটি নিয়ে যেসব নেতারা রয়েছেন আলোচনায় তাদের প্রায় প্রত্যেকেই নানা কারনে সমালোচিত ও বিতর্কিত।
নেতাকর্মীরা জানান, মহানগর বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি আবুল কালাম শারীরিকভাবে অসুস্থ্যতার কারনে ও বার্ধক্যজনিত কারনে তিনি দলীয় কর্মসূচিতে থাকতে পারছেন না দীর্ঘদিন যাবত। গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে আসার পর দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল দল থেকে বহিস্কৃত হয়েছেন। তারপর থেকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আব্দুস সবুর খান সেন্টু। যদিও এর আগেই এটিএম কামাল দেশের বাহিরে ছিলেন।
ঘটনা সূত্রে, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়ে নির্বাচন করেছিলেন অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। নির্বাচনে তৈমূর আলম খন্দকারের পক্ষে সরাসরি কাজ করেছেন এটিএম কামাল। যার ফলশ্রুতিতে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক তৈমূর আলম খন্দকার ও মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল বিএনপি থেকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার হয়েছেন। এটিএম কামালকে বহিস্কারের পর তিনি আবারো আমেরিকায় চলে যান। সেই থেকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হয়ে দায়িত্বে রয়েছেন আব্দুস সবুর খান সেন্টু। সভাপতি আবুল কালাম বরাবরেই মতই পূর্বের ন্যায় রাজপথের সক্রিয় রাজনীতিতে নিস্ক্রিয়। এমন পরিস্থিতিতে মহানগর বিএনপির পরবর্তী কমিটি প্রায় আসন্ন। যে কোনো সময় হয়তো ঘোষণা আসতে পারে মহানগর বিএনপির নতুন কমিটি।
এমন পরিস্থিতিতে মহানগর বিএনপির পরবর্তী নেতৃত্ব কাদের হাতে ওঠতে যাচ্ছে সেটা নিয়ে নেতাকর্মীদের মাঝে নানা সমীকরণে নানা হিসেব নিকেশ কষছেন নেতাকর্মীরা। কার্যত শক্তিশালী মহানগর বিএনপির কমিটি দেখতে চায় নেতাকর্মীরা। বর্তমান কমিটির সভাপতি আবুল কালাম দীর্ঘ রাজনীতির অভিজ্ঞতার কারনেই নেতৃত্বে এসেছেন বারবার। তিনি সব সময়ই টেবিল রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বিপুল সংখ্যক কর্মীসমর্থক থাকায় এবং বিএনপির প্রয়াত নেতা হাজী জালালউদ্দীনের সন্তান হওয়ার সুবাদে তার হাতেই বারবার ওঠছে নেতৃত্ব। এবার পরবর্তী কমিটিতে তাকে না রাখার সম্ভাবনাই প্রবল।
নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন- নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সভাপতি পদে যখন নারায়ণগঞ্জের আলোচিত আইনজীবী নেতা ও মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খান নিশ্চিত, তখন কেন্দ্রীয় বিএনপি সেক্রেটারি পদে কাকে বসাবে সেই বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। যার ফলে কমিটি এখনো পর্যন্ত ঝুলে আছে। কারন মহানগর বিএনপির সেক্রেটারি পদ প্রত্যাশি হিসেবে দৌড়ঝাপ করছেন মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি আতাউর রহমান মুকুল, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু, আবুল কাউসার আশা, আব্দুস সুবর খান সেন্টু ও মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ।
নেতাকর্মীরা জানান, এদের মধ্যে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরাসরি প্রকাশ্যে আওয়ামীলীগ ও জাতীয় পার্টির হয়ে কাজ করেছেন আতাউর রহমান মুুকুল। এক সময় দাবি করতেন তিনি বন্দর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার কারনে আওয়ামীলীগ ও জাতীয় পার্টির হয়ে কাজ করছেন। কিন্তু তার চেয়ারম্যানশীপ চলে যাওয়ার পরেও সরকারি দল ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে কাজ করে আসছেন। এবার তিনি হটাত করে আওয়ামীলীগ ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে দুরত্ব দেখিয়ে এখন বিএনপিতে ফিরে আসার চেষ্টা করছেন শীর্ষ পদে আাসিন হওয়ার জন্য। গত জাতীয় নির্বাচনে প্রকাশ্যে মুকুল জাতীয় পার্টির লাঙ্গলের পক্ষ নিয়ে ভোটের দিন বিএনপির এজেন্টদের মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয় মুকুল-এমন অভিযোগ করেছিলেন ধাণের শীষের প্রার্থী। মুকুল প্রকাশ্যেই মিটিং মিছিল সভা সমাবেশ করেছেন লাঙ্গলের পক্ষে। বন্দরে প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামনে এক অনুষ্ঠানে মুকুল ঘোষণা দিয়েছিলেন, এমপি সেলিম ওসমানের পাশে আছি এবং সব সময় থাকবো। বন্দর উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের ফুলের নৌকা উপহার নিজ হাতে তুলে দিয়েছিলেন মুকুল। সেই মুকুল এবার বিএনপিতে ঘা ভাসিয়েছেন মহানগর বিএনপির নেতৃত্ব ভাগিয়ে নিতে। ২০০৯ সালে বন্দরে বিএনপির বিদ্রোহী কমিটি ঘোষণা করে নিজেকে বিদ্রোহী কমিটির সভাপতি ঘোষণা করেছিলেন মুকুল।
আবার অনেকেই মনে করতেন আবুল কালামকে সভাপতি পদ থেকে সরালে সেক্রেটারি পদে আসিন হতে পারে তার ছেলে আবুল কাউসার আশা। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে মেয়র আইভীর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন তিনি। আইভীর পা ছুয়ে সালাম করে আইভীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান আশা। এমনকি আইভীর সঙ্গে এখন সরকারি দলের নানা প্রজেক্টের কর্মকান্ডে ছুটে যাচ্ছেন আশা। যদিও নির্বাচনের পূর্বেই এলাকায় গুঞ্জন ছিলো নৌকার প্রার্থী আইভীর লোকজন কাউন্সিলর প্রার্থী আশার পক্ষে কাজ করছেন এবং বিভিন্নভাবে আশাকে সহযোগীতা করছেন। নির্বাচনের পর আশার আচরনে তা সত্যে পরিনত হয়।
অন্যদিকে এক সময় মহানগর বিএনপির পরবর্তী নেতৃত্ব মনে করা হতো সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ও মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদকে। কিন্তু তিনি বর্তমানে একজন নারীর ধর্ষণ মামলায় কারাগারে রয়েছেন। নারী ঘটিত কারনে তিনি রাজনীতিতে বেশ পিছিয়ে গেছেন। সেখানে আবার বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার আপন বড় ভাই তৈমুর আলম খন্দকারের বহিস্কার। একই সঙ্গে করোনাকালে এমপি সেলিম ওসমান ও শামীম ওসমানের সঙ্গে খোরশেদের সখ্যতাও প্রকাশ পায়। সেলিম ওসমান তো খোরশেদকে বীর বাহাদুর বলে সম্বোধন করায় তা নিয়ে খোরশেদ ও খোরশেদের লোকজন আকাশে ওঠে যায়, তারা দাবি করে ওঠে এটা নাকি খেতাব! যুবদলের সভাপতি পদে থেকেও দলের ব্যানারে কোনো কর্মসূচি পালন না করেই বানিয়েছেন টিম খোরশেদ নাম দিয়ে সংগঠন। তার বড় ভাই তৈমূর আলমের মুখে সিটি নির্বাচনে ওসমানী প্রসংশা ফুটে ওঠেছে বারবার। ওসমানিদের কাধে ভর করে মেয়র হওয়ার স্বপ্ন পুরণ না হলেও দল থেকে বহিস্কার হয়েছেন তিনি।
তবে আব্দুস সবুর খান সেন্টু বয়সের কারনে পিছিয়ে গেলেও তিনি মহানগর বিএনপির প্রায় সকল কর্মসূচিতেই সক্রিয় থাকছেন। যেখানে সামনে থেকে নেতৃত্বও দিচ্ছেন আবু আল ইউসুফ খান টিপু। এক সময় বিশাল শোডাউনে পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করতেন সাখাওয়াত হোসেন খান। দলের নেতাদের আপত্তির কারনে তিনি এখন সকলের সঙ্গে মিলেই দলের কর্মসুচিতে অংশগ্রহণ করছেন। সামনে কমিটির নেতৃত্ব প্রত্যাশিদের মধ্যে সাখাওয়াত ও টিপুর সম্ভাবনাই বেশি। ১/১১ এর কঠিন সময়ে যখন কেউ ভয়ে মুখ খুলতো না, তখন যে ক’জন নেতা বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম সাখাওয়াত ও টিপু। তারা জুটি বেধে তখন থেকেই দলের জন্য কাজ করে আসছেন।
২০১৬ সালে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন সাখাওয়াত। ওই সময় টিপুকে সঙ্গে নিয়ে তুমুল লড়াই করেছেন তিনি। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের বেশকজন নেতারা প্রকাশ্য বিরোধীতার পরেও সাখাওয়াত ও টিপুর শক্ত অবস্থানের কারনে ধানের শীষ নিয়ে লড়াই করেছেন। সেই পরিস্থিতির চেয়ে তাদের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। এসব কারনে নেতাকর্মীরা মনে করছেন- মহানগর বিএনপির নেতৃত্বে সাখাওয়াত হোসেন খান ও আবু আল ইউসুফ খান টিপুর নেতৃত্বে ভিন্নমাত্রা যোগ হবে মহানগর বিএনপির রাজনীতিতে। কারন দুজনই রাজপথের সক্রিয় রাজনীতিক। দুজনের রাজনৈতিক দীর্ঘ ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে। ১/১১ এর মত কঠিন সময়েও দু’জন রাজপথে একসাথে আন্দোলন করেছেন।