সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলায় আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের মুখে ‘মীরজাফর ও বেঈমান’ শব্দ দুটি বেশ আলোচিত হয়ে ওঠেছে। বিশেষ করে ১৭ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ নির্বাচনে ৩নং ওয়ার্ডে স্থানীয় আওয়ামীলীগের সমর্থিত সদস্য প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান মাসুমের পরাজয়ের পর এমন সমালোচনা চলছে কঠোর। তাদের যুক্তি ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র একটিতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় কিভাবে জাতীয় পার্টির আবু নাইম ইকবাল বিজীয় হয়? অথচ নির্বাচনের দিন দেখা গেলো সকল চেয়ারম্যানেরা তাদের পরিষদের মেম্বারদের সঙ্গে নিয়ে ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। সোনারগাঁয়ের রাজপথে বিএনপি জামাত জোট সরকার আমলে রাজনীতি করা নারী সদস্য প্রার্থী মহিলা লীগ নেত্রী অ্যাডভোকেট নূর জাহান পেলো মাত্র ২৩টি ভোট, আর রূপগঞ্জের প্রার্থী শীলা রানী ৮৩ ভোট ও আড়াইহাজারের শাহিদা মোশারফ পেলো ২৬ ভোট।
তবে সোনারগাঁয়ের আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে মীরজাফর ও বেঈমানীর রাজনীতি নতুন কিছু নয়। তার লম্বা ইতিহাস রয়েছে। এই মীরজাফর ও বেঈমানীর রাজনীতির কারনে সচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক গাজী মজিবুর রহমানের মত ব্যক্তিও বলির পাঠা হয়েছেন। নোয়াগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন শেষে নৌকার প্রার্থী আব্দুল বাতেন পরাজিত হয়ে ফেসবুক লাইভে দুই চোখের জলও সোনারগাঁয়ে বেঈমানীর রাজনীতি ঠেকাতে পারেনি। এই মীরজাফর ও বেঈমানীর রাজনীতি ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচন থেকে প্রকাশ্যে শুরু। হয়তো তার আগে থেকেও। কিন্তু সর্বশেষ মোস্তাফিজুর রহমান মাসুমের পরাজয়ের মাধ্যমে।
চলতি বছরের ৩ সেপ্টেম্বর সোনারগাঁও উপজেলা আওয়ামীলীগের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম এমপি তার বক্তব্যে সোনারগাঁয়ের নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, আমরা নৌকার প্রার্থী দিলাম, কিন্তু আওয়ামীলীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে নজির স্থাপন করেছেন যে, নিজেরা ভেদাভেদ সৃষ্টি করে নৌকাকে ডুবিয়ে দেয়ার নজির আপনারা স্থাপন করেছেন। আবার আওয়ামীলীগের এমপি মনোনয়ন দিবে, আপনারা গ্রুপিং করে নৌকাকে ডুবাবেন, তার চেয়ে তো জাতীয় পার্টিকে দেয়া আরো ভালো।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচয়ের পূর্বে জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামীলীগে যোগদান করেই নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নৌকা প্রতীক পেয়ে যান আবু নূর মোহাম্মদ বাহাউল হক। নির্বাচনে আওয়ামীলীগের একটি অংশের নেতাকর্মীরা মেনে নিতে পারেনি। সে কারনে প্রকাশ্যে নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে গোপনে কাজ করেন। যার ফলশ্রুতিতে বাহাউল হক পরাজিত হোন।
২০১১ সালে সোনারগাঁও পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী ছিলেন তৎকালীন সোনারগাঁও উপজেলা যুবলীগ সভাপতি গাজী মজিবুর রহমান। সেই নির্বাচনে একজন জনপ্রিয় প্রার্থী ছিলেন তিনি। যুবলীগের রাজনীতি করলেও স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতির কারনে এলাকায় তার ব্যাপক সুনাম রয়েছে। ওই নির্বাচনে বিএনপি জামাত জোটের সমর্থিত মেয়র প্রার্থী ছিলেন সাদেকুর রহমান ভুঁইয়া। তবুও আওয়ামীলীগের একটি অংশ গাজী মজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। যার ফলে জয়ের খুব কাছাকাছি গিয়েও জয়ী হতে পারেননি তিনি।
২০১৬ সালে সোনারগাঁও পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নৌকা প্রতীক পান অ্যাডভোকেট এটি ফজলে রাব্বী। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির এমপি সহ স্থানীয় আওয়ামীলীগের একজন শীর্ষ নেতা নৌকার বিরোধীতা করে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাদেকুর রহমানের পক্ষে কাজ করেন। যার নাটের গুরু ছিলেন জেলার একজন প্রভাবশালী এমপি। নির্বাচনের দিন নৌকার পক্ষে আওয়ামীলীগের লোকজনদের ভুমিকা দেখে মনে হয়েছিলো তারা সবাই সাদেকুর রহমানের পক্ষের লোক। ফলে নির্বাচনে নৌকা পরাজিত হয়। সাদেকুর রহমানের জয় হয়।
২০১৭ সালে সোনারগাঁও উপজেলার শম্ভুপুরা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পান জেলা মহিলা লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সোনারগাঁও উপজেলা মহিলা লীগের সভাপতি নূর জাহান। ওই নির্বাচনে আওয়ামীলীগের বৃহত্তর অংশের নেতাকর্মীরা জাতীয় পার্টির সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী আব্দুর রউফের পক্ষে কাজ করেন। উপজেলার শীর্ষ নেতারাও তার পাশে দাঁড়াননি নানাভাবে ম্যানেজ হয়ে। নৌকা প্রতীক পেয়ে উল্টো অসহায় হয়ে পড়েন নূর জাহান। নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে পরাজিত হোন।
২০২১ সালে সোনারগাঁও উপজেলার মোগরাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পান হাজী শাহ মোহাম্মদ সোহাগ রনি। নৌকার বিরোধীতা করে বিদ্রোহী প্রার্থী হোন আরিফ মাসুদ বাবু। উপজেলার শীর্ষ নেতারা প্রকাশ্যে নৌকার বিরোধতিা করেন এবং শেষ পর্যন্ত নৌকাকে ডুবিয়ে ছাড়েন। নির্বাচনে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ থেকে শুরু করে উপজেলার শীর্ষ নেতারা নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করেন। এমন অভিযোগ তুলে সোহাগ রনি দলটির প্রধাণ শেখ হাসিনা বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন।
এর আগে নোয়াগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পান আব্দুল বাতেন। এই নির্বাচনেও নৌকাকে ডুবাতে আওয়ামীলীগের নেতারা নৌকার বিরোধীতা করে অপর দুই প্রার্থী সামসুল আলম সামসু ও ইউসুফ দেওয়ানের পক্ষে কাজ করেন। শেষতক নৌকার প্রার্থী আব্দুল বাতেন পরাজিত হোন। নির্বাচনের পর তিনি ফেসবুকে লাইভে এসে কান্নাজড়িত কন্ঠে আওয়ামীলীগে নেতাদের দায়ী করেন পরাজয়ের কারন। নির্বাচনে তৎকালীন জাতীয় পার্টি নেতা সামসুল আলম সামসু জয়ী হলে দুদিনের মাথায় তাকে আওয়ামীলীগে যোগদান করান উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি সামসুল ইসলাম ভুইয়া।
এদিকে ১৭ অক্টোবর হয়ে গেলো নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের নির্বাচন। জেলা পরিষদের ৩নং ওয়ার্ডের সদস্য প্রার্থী ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান মাসুম ও আবু নাঈম ইকবাল। ইকবালকে নিয়ে স্থানীয় এমপি লিয়াকত হোসেন খোকা সহ জাতীয় পার্টি মাঠে নামেন। মাসুমকে নিয়ে মাঠে উপজেলা আওয়ামীলীগের শীর্ষ তিন নেতা। তারা মাসুমকে আওয়ামীলীগের প্রার্থী ঘোষণা দেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে যখন প্রমাণ করা জরুরী সোনারগাঁয়ের জনপ্রতিনিধিরা কার পক্ষে, তখন আওয়ামীলীগের সিংহভাগ জনপ্রতিনিধিরা ভোট দিলো জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে। ফলে ইকবাল জয়ী হোন। ১৩২টি ভোটের মধ্যে ৮৩টি ভোট পেয়েছেন ইকবাল। অথচ সোনারগাঁও উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৭জন নৌকার চেয়ারম্যান, দুজন স্বতন্ত্র হলেও তারা আওয়ামীলীগের রাজনীতি করেন। একজন মাত্র জাতীয় পার্টির। নির্বাচনের দিন চেয়ারম্যানদের দেখা গেলো মেম্বারদের সঙ্গে নিয়ে ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করতে। কিন্তু তবুও মাসুম পরাজিত।