সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:
২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার আলীরটেক ইউনিয়নের এক সরিষা ক্ষেতে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর ১০ বছরের শিশু গণধর্ষণের পর হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে ফাঁসির দন্ডে দন্ডিত প্রধান আসামী সুজন দীর্ঘ ১৯ বছর পলাতক থাকার পর ঢাকার বাড্ডা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১১। ২৪ অক্টোবর সোমবার বিকেলে এ তথ্য জানান র্যাব-১১ এর মিডিয়া অফিসার এএসপি রিজওয়ান সাঈদ জিকু।
তিনি জানান, গত ১১ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ জেলার সদর থানা হতে একটি অধিযাচনপত্রে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত সাজাপ্রাপ্ত ওয়ারেন্টভুক্ত আসামী সুজন ওরফে মোঃ নিজামুল হককে গ্রেপ্তারের জন্য র্যাব-১১কে অনুরোধ করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে বর্ণিত বিষয়ে র্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে। এক পর্যায়ে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে র্যাব নিশ্চিত হয়। ফলশ্রুতিতে, র্যাব উক্ত আসামীকে গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।
পরবর্তীতে র্যাব-১১ এর একটি গোয়েন্দা দল গোপন তথ্যের মাধ্যমে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামীর অবস্থান সনাক্ত করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে র্যাব সদর দপ্তরের সহযোগিতায় তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে আসামীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। তার গতিবিধি পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, সে প্রতিনিয়ত অবস্থান পরিবর্তন করছে এবং গ্রেপ্তার এড়াতে বিদেশ গমনের পরিকল্পনা করছিল।
র্যাব আরো জানায়, এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব-১১ এর অভিযানে গত ২৩ অক্টোবর রাতে ডিএমপি, ঢাকার বাড্ডা থানা এলাকা হতে সুজন ওরফে মোঃ নিজামুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত আসামী তার অপরাধ সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে।
র্যাব জানায়, ২০০৩ সালের গত ১৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ জেলার সদর থানাধীন আলীরটেক এলাকায় একটি ১০ বছরের শিশু গণধর্ষণপূর্বক হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। হত্যাকান্ডের পরবর্তী দিন শিশুটির লাশ সরিষা ক্ষেতে পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় জনগন সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ ও শিশুটির পরিবারকে জানায়। পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে লাশটিকে উদ্ধার পূর্বক সুরতহাল তৈরী করে এবং লাশটি সদর উপজেলার আলীরটেক এলাকার আলী আকবরের মেয়ে খাদিজা আক্তার বলে সনাক্ত হয়। এই ঘটনায় ভিকটিমের ভাই বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এ একটি মামলা দায়ের করেন, যার মামলা নং ০৯(০১)০৩, ধারা ৯(৩)। পরবর্তীতে নিহতের ময়না তদন্তের রিপোর্টে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল মর্মে উল্লেখ করা হয়। উক্ত ঘটনাটি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা ও সংবাদমাধ্যমে চাঞ্চল্যকর সংবাদ হিসেবে বহুল প্রচারিত হয়।
ঘটনার দিন দুপুরে ভিকটিম খাদিজা এবং তার এক প্রতিবেশী বান্ধবী আলীরটেকে অনুষ্ঠিতব্য একটি মাহফিল দেখার জন্য ১নং আসামী সুজনের বাড়ীতে যায়। সুজন নিহত ভিকটিমের দুঃসম্পর্কের আত্মীয় বলে জানা যায়। সুজনের বাড়ীতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে প্রতিবেশী বান্ধবীর নিকটস্থ খালার বাসায় তারা বেড়াতে যায়। পরবর্তীতে রাত হয়ে গেলে ভিকটিমের বান্ধবী তার খালার বাসায় থেকে যায়। ইতিমধ্যে পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে সুজন ভিকটিমকে তার বাড়ীতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে সাথে নিয়ে আসে। পথিমধ্যে সুজন এবং ওৎ পেতে থাকা তার আরও তিন সহযোগী পরস্পর যোগসাজশে ভিকটিমকে জোরপূর্বক একটি সরিষা ক্ষেতে নিয়ে ভিকটিমের পরিহিত পোশাক দিয়ে হাত, পা এবং মুখ বেধে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের এক পর্যায়ে এই চার নরপিশাচ ভিকটিমের বুকের পাজর, হাত ও পা বিকৃত করে শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারাত্মক জখমসহ শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। তারা এতই নৃশংস ছিল যে ভিকটিমের মৃত্যু পরও ধর্ষণ চালিয়ে যায়। ধর্ষণ শেষে লাশটিকে সরিষা ক্ষেতে রেখে সবাই পালিয়ে যায়।
পরবর্তীতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত, নারায়ণগঞ্জ বিচার শেষে মামলার পলাতক আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ৯(৩) ধারায় অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমানীত হওয়ায় গত ১১ জুন ২০১৮ তারিখে চার গণধর্ষককে উক্ত আইনের উক্ত ধারার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত পূর্বক মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করার আদেশ দেন। আদালত মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন সাপেক্ষে ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৬৮ ধারায় বর্ণিত বিধান মোতাবেক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত উক্ত আসামীকে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কর্যকর করার আদেশ প্রদান করেন।
গ্রেপ্তারকৃত আসামীর ভাষ্যমতে ঘটনার পর পরেই সে দেশের বিভিন্ন জেলায় আত্মগোপন করে। দীর্ঘদিন পর সে নারায়ণগঞ্জে ফেরত এসে পরিচয় গোপন করে ২নং রেলগেটস্থ একটি কাপড়ের দোকানে চাকুরী করা শুরু করে এবং এই পেশাকে গ্রেপ্তার এড়ানোর ঢাল হিসেবে বেছে নেয়। ইতিমধ্যে সে নিজের নাম এবং বয়স পরিবর্তন করে ২০১৪ সালে পাসপোর্ট ও ২০১৬ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরী করে। দীর্ঘদিন চাকুরী করে ২০১৭ সালে সে ইরাকে গমন করে এবং ২০২১ সালে বাংলাদেশে ফেরত আসে। দেশে ফিরে সে জমি সংক্রান্ত ব্যবসায় জড়িত হয়। পরবর্তীতে ২০২২ সালের মার্চ মাসে সে পুনরায় সংযুক্ত আরব আমিরাত গমন করলেও সুবিধা করতে না পেরে ৩ মাস পর দেশে ফেরত আসে। দেশে ফেরত এসে সে আত্মাগোপনে অবস্থান করতে থাকে।
এই নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত অন্য ০৩ আসামীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে র্যাব-১১ এর অভিযান অব্যাহত রয়েছে।