পারেনি সেলিম ওসমান ও শামীম ওসমান: এসপি দেখালেন ‘অ্যাস পার ল’

সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:

গত ৯ এপ্রিল যখন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদের সঙ্গে একটি বৈঠকে মিলিত হন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের মহাজোটের এমপি সেলিম ওসমান তখন সেলিম ওসমান বলেছিলেন, ‘আজকের পর হয়তো বরফ গলবে।’ ওই বৈঠকে পুলিশ সুপার সাফ জানিয়েছিলেন, আমাদের মাঝে কোন বরফই নেই। সুতরাং বরফ গলার প্রশ্নই ওঠেনা।’ এসপি আরও বলেছিলেন, পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করলে যদি কেউ আপনাদের লোক হয় তাহলে অ্যাস পার ‘ল’ আদালত থেকে জামিন করিয়ে নিবেন। আইন সবার জন্য সমান। আমরা গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠাবো আপনারা জামিন করিয়ে নিবেন।’ তবে বরফ গলাতে পারেনি সেলিম ওসমান। আবার নেতাকর্মীদের আশ^স্ত করে ১২ দিনে যা টের পাওয়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সেটাও পারেনি শামীম ওসমান। উল্টো তার ঘনিষ্ট কর্মী পুলিশের হাতে চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেপ্তার হলেন।

ছবি- গত ৬ এপ্রিল জরুরী কর্মী সভায় পুলিশ সুপারকে ইঙ্গিত করে শামীম ওসমান বক্তব্য রাখার সময় তার পাশেই ছিলেন গ্রেপ্তারকৃত ডিস বাবু।

যদিও এর আগে গত ৬ এপ্রিল ফতুল্লায় আওয়ামীলীগের এক জরুরী কর্মী সভায় এমপি শামীম ওসমান তার বক্তব্যে এসপিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘প্লিজ ডোন্ট প্লে এই নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জে খেইলেন না।’ নেতাকর্মীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে শামীম ওসমান বলেছিলেন, নারায়ণগঞ্জের সকল খবর আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী রাখেন। আর তাই আগামী ১০/১২ দিনের মধ্যেই টের পাইবেন।’ তবে শামীম ওসমানের এমন কথার ১২ দিন শেষ হওয়ার পরপরই তার ঘনিষ্ঠ কর্মী সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর আবদুল করিম বাবুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার করে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে তাকে আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ এবং আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন। ফলে এসপি তার বক্তব্যের সেই অ্যাস পার ‘ল’ বাস্তবায়ন করলেন এবং আইন সবার জন্য সমান তাও দেখালেন। কারন বাবু গ্রেপ্তারের পর বিকেলে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে শামীম ওসমানকে কিছুটা সময় দেখা যায়। তবে তিনি কি কাজে সেখানে গিয়েছিলেন তা জানা যায়নি। তিনি খুব দ্রুত সেখাল থেকে চলে যান।

জানাগেছে, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি একেএম সেলিম ওসমানকে গত ৯ এপ্রিল জেলা পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ তার কার্যালয়ে এক বৈঠকে বলে দিয়েছিলেন, আইন সবার জন্য সমান। পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তারের পর যদি দেখেন তারা আপনাদের লোক তাহলে কোন সমস্যা নাই, অ্যাস পার ‘ল’ আদালত থেকে জামিন করিয়ে নিবেন।’ এর আগে ৬ এপ্রিল শামীম ওসমান পুলিশ সুপারকে ইঙ্গিত করে এবং নেতাকর্মীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, আপনারা শান্ত থাকুন। নারায়ণগঞ্জে খেলা হবে না। কারো ফাঁদে পাড়া দিয়ে খেইলেন না। প্লিজ ডোন্ট প্লে এই নারায়ণগঞ্জে। আগামী ১০/১২ দিনের মধ্যেই টের পাইবেন।’ এর আগে গত ৩ এপ্রিল পুুলিশ তার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, অপরাধী কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা, যদি সে যত বড় ক্ষমতাশালী লোক হোক।’ এমন পরিস্থিতিতে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নববর্ষ পালন উৎসবে যান শামীম ওসমান। সেখানে শামীম ওসমান ও এসপির সোহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক দেখা যায়। নেতাকর্মীদের মাঝে কিছুটা স্বস্থিও দেখা যায়। কিন্তু ১৮ এপ্রিল চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেপ্তার হলেন শামীম ওসমানের ঘনিষ্টজন কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু। শামীম ওসমানের এমন ঘোষণার ১২ দিন পরপরই ডিস বাবুকে গ্রেপ্তার করলো পুলিশ।

এখানে উল্লেখ্যযে, গত ২৯মার্চ শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ কর্মী মহানগর আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহনিজামের বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানায় জিডি করেছিলেন ওই থানার ওসি শাহ মোহাম্মদ মঞ্জুর কাদের। জিডির একদিন পর ভারতে চলে যান শাহনিজাম। এছাড়াও এর দুইদিন পর ফতুল্লায় ভাসমান মেরী আন্ডারসন জাহাজের বার থেকে বিয়ার ও মদ উদ্ধার করে পুলিশ ও ৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় মামলায় শামীম ওসমানের শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটুকে মাদক বিক্রয়ে সহযোগীতাকারী হিসেবে মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। তিনিও ভারতে চলে গেছেন। এছাড়াও শিশু সাকি অপহরণের অভিযোগ করা হয় সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নাজমুল আলম সজলের বিরুদ্ধে। তিনিও পরবর্তীতে ওমরাহ পালনে সৌদি আরবে চলে গেছেন। এর আগে শামীম ওসমানের আরেক কর্মী মীর হোসেন মীরুকে দুইবার মামলা ও গ্রেপ্তার করা হয়। শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমানের শ্যালক বিকির বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হয়। নারায়ণগঞ্জ শহরের একটি জুয়ার আসন থেকে ৪২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। মহানগর শ্রমিকলীগের সেক্রেটারি কামরুল হাসান মুন্না ও বর্তমান সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর কবির হোসেন সহ ২২জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়।

এসব ঘটনার মধ্যে তিনটি ঘটনায় ব্যবসায়ীরা গত ৩ এপ্রিল প্রতিবাদ সভা করেছেন। ওই দিন নারায়ণগঞ্জ শহরে জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে মহড়া দিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ। ওইদিন শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে জলকামান, সাজোয়া যান, পুলিশ আর্ম কার দেখা যায়। এর আগে গত ২ মার্চ শামীম ওসমানের সমাবেশের সামনেও পুলিশের এমন প্রস্তুতি দেখা যায়। ৩ এপ্রিল ওইদিন বুধবার পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ বলেছেন, অপরাধী কাউকে ছাড় দিব না, সে যত বড় ক্ষমতাশালী লোক হোক।’

এদিকে গত ৬ এপ্রিল শনিবার ফতুল্লার বাংলা ভবনে জরুরী কর্মী সভা করেছেন শামীম ওসমান। যেখানে তিনি নারায়ণগঞ্জের সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আইভী, এসপি হারুন অর রশীদ ও কেন্দ্রীয় শ্রমিকলীগ নেতা কাউসার আহমেদ পলাশকে ইঙ্গিত করে বেশ কিছু বক্তব্য রাখেন। ওই কর্মী সভায় পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে শ্লোগানও দিয়েছিল নেতাকর্মীরা। পুুলিশের কঠোর অবস্থান নিয়ে বক্তারা সেদিন কঠোর সমালোচনাও করেন। এর আগে ৩ এপ্রিল ব্যবসায়ীরা প্রতিবাদ করেন। গত ৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেয়ার সিদ্ধান্ত জানালো পরবর্তীতে আর ব্যবসায়ীরা স্মারকলিপি দেননি।

ছবি- ১৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার আদালত থেকে কারাগারে নেয়ার পথে কাউন্সিলর ডিস বাবু।

জানাগেছে, ১৮ এপ্রিল বিকেলে নারায়ণগঞ্জ শহরের পাইকপাড়া এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু ওরফে ডিস বাবুকে চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেপ্তার করেছে নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। ডিস বাবু নারায়ণগঞ্জে স্যাটেলাইট কেবল ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করেন। তিনি এমপি শামীম ওসমানের ঘনিষ্ট কর্মী হিসেবেই পরিচিত।

এর আগে আব্দুল করিম বাবুর বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ বন্দরের ফরাজীকান্দা এলাকার অপর ডিস ব্যবসায়ী হাসান একটি চাঁদাবাজি মামলা দায়ের করেন। তাকে গ্রেপ্তার করে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ। আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়।

ছবি- ১৮ এপ্রিল পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে শামীম ওসমান, বের হয়ে যাওয়ার সময়কার ছবি। তবে কি কাজে সেখানে গিয়েছেন তা জানা যায়নি।

নারায়ণগঞ্জ ডিবির পরিদর্শক এনামুল হক জানান, বন্দর থানায় হাসান নামের একজন ডিস ব্যবসায়ী ১০ লাখ টাকা চাঁদাবাজীর মামলা করেছে কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবুর বিরুদ্ধে। ওই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাবুকে নিয়ে আরো আসামি ধরতে অভিযান চলছে।

গত ২৩ মার্চ ভুক্তভোগী মো. হাসান ব্যবসায়ী বন্দর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। হাসান জানান, বন্দর সোনাকান্দা হতে আলীনগর হয়ে প্রায় কয়েক লাখ টাকার ডিস লাইনের ক্যাবল সহ সরাঞ্জমাদি কেটে নিয়ে গেছে ফরাজীকান্দা এলাকার সন্ত্রাসী সজিব গং। ডিসের ক্যাবল কাটার কারণে প্রায় ২ হাজার গ্রাহক ডিস লাইনের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এ ঘটনায় বাবু ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবী করে।