আগামী ১৭ জুন নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সম্মেলন। এই সম্মেলনের কয়েক ঘন্টা পূর্বে সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মাসুকুল ইসলাম রাজীবকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর দেয়া কারণ দর্শানো নোটিশটি তাদের দল বিএনপিকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে বলেই মনে করছি। দেশের বৃহত্তর একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এমন একটি নোটিশ নারায়ণগঞ্জে বেশ আলোচিত সমালোচিত হয়ে ওঠছে। সরকারি দলও মুচকি হাসি দিয়ে টিপ্পুনী কাটছে।
আমি সাধারণত কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে নিজের মতামত প্রকাশ কিংবা রিভিউ দেইনা। এখনো পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শ লালনও করি না। তাই রাজনৈতিক বিষয়গুলো এড়িয়ে চলি। তবে দীর্ঘদিন স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতার সুযোগে রাজনীতি নিয়ে নিজে নিজে একটু আধটু ঘাটাঘাটি করেছি। আর এ কারনেই যখন বিএনপির একটি নোটিশ নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের নানা প্রশ্নগুলো সামনে চলে আসছে, তখন সেই বিষয়গুলো তুলে ধরতে চাই এবং এ ধরণের হটকারী সিদ্ধান্তে একটি রাজনৈতিক দলকে নিজ দলের কর্মীদের কাছে কতখানি প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে সেটা যতটুকু সম্ভব তুলে আনতে চাই। বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে আনতে একটু লম্বা হতে পারে লেখাটি, সে কারণে পাঠক সমাজ বিরক্ত হবেন না। অবশ্যই লেখার উপসংহারে লেখাটির মর্মার্থ থাকবে।
একটু পেছনে যাই, গত বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দীনকে আহ্বায়ক ও গোলাম ফারুক খোকনকে সদস্য সচিব করে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। খোকনকে জেলা যুবদলের আহ্বায়ক পদে বহাল থাকাবস্থায় এই পদে আনা হয়, এখনো তিনি রয়েছেন। ওই কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক পদে আসেন মাসুকুল ইসলাম রাজীব। কমিটিতে ১নং যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয় মামুন মাহামুদকে, যেখানে ইউনিট কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে মামুন মাহামুদেরও স্বাক্ষর লাগবে বলে শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে মামুন মাহামুদের বিনা স্বাক্ষরেই জেলা বিএনপির আওতাধীন বিভিন্ন ইউনিট কমিটিগুলো গঠন করা হয়, যে বিষয়গুলোর কোনো তদারকিই করেনি কেন্দ্রীয় বিএনপি।
যাইহোক প্রসঙ্গ বাড়াতে চাই না। এদিকে সম্মেলনের পূর্বেই বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় সভাপতি হয়েছেন মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দীন। সাধারণ সম্পাদক পদে মাসুকুল ইসলাম রাজীব ও গোলাম ফারুক খোকনের মধ্যে ভোটাভুটি হবে এমনটা প্রায় নিশ্চিত। ১৪ জুন রাজধানীতে গিয়ে রূপগঞ্জ উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় খোকনের পক্ষালম্বন করে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান দিপু ভুঁইয়া। ওই সভায় রাজীবের বিরুদ্ধে নানা ধরণের অভিযোগ তোলা হয়, যা গণমাধ্যমে বিরাট আকারে প্রকাশ পায়।
আর সেই সভার নেতাকর্মীদের বক্তব্যের বিষয়ে ও গণমাধ্যমে রাজীবের বিরুদ্ধে প্রকাশিত খবরের বরাত দিয়ে রাজীবকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন রুহুল কবির রিজভী। এবার আলোচনায় আসি নোটিশটির বিষয়গুলো নিয়ে। ১৫ জুন রাতে রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত নোটিশটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পায়, ততক্ষণে হয়তো নোটিশ প্রাপকের হাতেও পড়েনি। কারন পরদিন বিকেলে তিনি জানিয়েছেন নোটিশটি তিনি পেয়েছেন। তার আগেই ফেসবুকে নোটিশটি ভাইরাল। নোটিশটি মধ্যরাতে প্রকাশিত হলেও পরদিন শুক্রবার স্থানীয় প্রিন্ট মিডিয়াগুলো বেশ ফলাও করে বিরাট আকারেই প্রকাশও করেছে। এতে ধারণা করা যায় নোটিশটি নিয়ে নোটিশের সুবিধাভোগী পক্ষ দৌড়াদৌড়িও করেছেন বেশ।
এবার আসি নোটিশে যে যে অভিযোগগুলো আনা হলো। রাজীবকে কারণ দর্শানো নোটিশে উল্লেখ করা হয়, আপনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট নামে একটি ভূঁইফোড় সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছেন বলে আমরা গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে জানতে পেরেছি। দল আরও অবহিত হয়েছে যে, আপনি শুধুমাত্র উক্ত সংগঠনের সাথে যুক্তই হননি, বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি, নানাবিধ অপপ্রচার ও দলবিরোধী ষড়যন্ত্রে জড়িত আছেন। আপনার এহেন তৎপরতা শুধু সংগঠন বিরোধীই নয়, বর্তমান দুঃসময়ে দলের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। সুতরাং উল্লিখিত ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতার জন্য কেন আপনার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, সে বিষয়ে কারণ দর্শিয়ে আগামী ০৫ (পাঁচ) দিনের মধ্যে একটি লিখিত জবাব দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। বিষয়টি অতীব জরুরী।
এই নোটিশের পর এখন দলের প্রতি নেতাকর্মীদের যেমন প্রশ্ন, ঠিক আমারো প্রশ্ন- ২০১৩ সালে বিএনএফ কমিটির একটি খসড়া কাগজ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, সেই কাগজটিতে মাসুকুল ইসলাম নামে একজনকে সদস্য সচিব দেখানো হয়। তাহলে সেই বিষয়ে এত্ত বছর পর কেন জবাব চাইবে বিএনপি? সেই বিষয়টি প্রকাশের পর রাজীবকে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক করা হলো, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদকও করা হলো, বিগত কমিটিতেও রাজীবকে সদস্য রাখা হলো এবং সর্বপরি বর্তমান কমিটিতেও তাকে যুগ্ম আহ্বায়কও করলেন। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় সম্মেলনের দু’দিন আগে কেন এমন অভিযোগ তুলে কারণ দর্শানোর নোটিশ? বিএনফ টিএনএফ কিছুই না, বিষয়টি পরিষ্কার- রাজীবকে সম্মেলনে প্রার্থী হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করা। অর্থাৎ হাই কমান্ড চায় না রাজীব প্রার্থীতায় থাকুক এবং খোকনকেই জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পদে রাখতে চায়।
এখন আমার পর্যবেক্ষণ হলো- একটা দলের আভ্যন্তরীণ নানা সিদ্ধান্ত থাকতেই পারে। কৌশল থাকতেই পারে। কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে কেন এবং দল কেন কর্মীদের প্রশ্নের মুখে পড়বে? কারন দলকে বুঝা উচিত- স্থানীয় যারা ভোটাভুটিতে রাজীবকে দেখতে চায় না, তাদের ভয় বেশি এবং তাদের ভোটের সংখ্যা কম। তাহলে রাজীবের ভোট বেশি, অর্থাৎ কর্মী বেশি। তবুও এখন দল যদি রাজীব নয়, অন্য কাউকে নেতৃত্বে দেখতে চায় তাহলে সেটা প্রকাশ্যে নোটিশ দিয়ে বিতর্কিত করে রাজীবকে সরাতে হবে কেন? ভিন্ন মসৃণ পথেও রাজীবকে সরিয়ে খোকনকে দায়িত্বে রাখা যায়। দলের আরো বুঝা উচিত যদি নোটিশ দিয়ে রাজীবকে সরাতে চায় তাহলে স্থানীয় অধিকাংশ কর্মীদের কাছে প্রশ্নের মুখে পড়বে দল, আর সেটাই হয়েছে নারায়ণগঞ্জে।
এই প্রশ্নবিদ্ধ নোটিশের ফলে দলের চাওয়াটা অধিকাংশ নেতাকর্মীরা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু অধিকাংশ কর্মীদের পছন্দের নেতাকে এভাবে বিতর্কিত করে নেতৃত্বে আসার পথে তাদের দলই বাধা সৃষ্টি করবে এটা তারা মেনে নিতে পারছে না। কারন বিএনএফে যুক্ত থাকার অভিযোগটি একেবারেই ঢুনকো, যেখানে একই কাগজে আরো যাদের নাম এসেছিলো, সেইসব নেতা-নেত্রীরা নারায়ণগঞ্জে বিএনপির শীর্ষ পদের নেতৃত্বে বহাল রয়েছেন। ছাত্র রাজনীতি থেকে তীল তীল করে ওঠে আসা একজন কর্মীবান্ধব নেতাকে এভাবে দল ক্ষতিগ্রস্থ করবে সেটা কর্মীরা মানসিকভাবে মানতে পারছে না।
কার্যত এই ধরণের হটকারী নোটিশে নারায়ণগঞ্জের বিপুল সংখ্যক কর্মীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলো, এতে বিএনপিই ক্ষতিগ্রস্থ হলো। দলের প্রতি কর্মীদের ভয় সৃষ্টি হলো, কর্মীরা হতাশায় পড়ে গেল। দলের আভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত পর্দার আড়ালে রাজীবকে জানিয়ে তাকে সরিয়ে দিলেই কেবল দল প্রশ্নের মুখে পড়তো না, যেটা বর্তমানে হয়েছে। দলের এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হলে এই ধরণের হটকারী নোটিশ প্রত্যাহার করে সম্মেলনে রাজীবকে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া উচিত। এতেই দল লাভবান হবে বলে মনে করছি। এই ধরণের ভুল সিদ্ধান্তের আগে ভবিষৎে বিএনপিকে আরো সতর্ক হওয়া উচিত বলেই মনে করি, নতুবা আপনাদের দল এভাবে আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
লেখক: মাজহারুল ইসলাম রোকন
আইনজীবী ও কলামিস্ট