সান নারায়ণগঞ্জ
গত ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর মাঝে কিছুটা আতংক বিরাজ করছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে পুলিশ আপাতত কারো কাছে উৎকোচ দাবি করছে না। কিন্তু চরিত্র বদলায়নি নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশ। এখানকার পুলিশের কাছে জিম্মি হয়ে আছে বিচারপ্রার্থী, আইনজীবীরাও। টাকা ছাড়া কোনো নথি দেখতেও পারছেনা আইনজীবীরা। মামলার নথি পুটআপ থেকে শুরু করে জামিনের আদেশ সংগ্রহ পর্যন্ত মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কোর্ট পুলিশ।
নারায়ণগঞ্জের সাতটি থানার জন্য সাতটি জিআরও সেকশনে পুলিশ রয়েছে, যারা এখনো বেপরোয়াভাবে টাকা পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে। আইনজীবীদের তোয়াক্কাই করছেনা কোর্ট পুলিশ। এক সময়কার বকশিস এখন হয়ে ওঠেছে মোটা অংকের ঘুষ বানিজ্য। ঘুষ না দিলে হয়রানির সীমা থাকেনা। নথিপত্র দেখানো তো দূরের কথা নথি লুকিয়ে রেখে আইনজীবীদের হয়রানি করা হয়।
একজন আসামীকে জামিনের পর জেল থেকে বের করা পর্যন্ত আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীর খরচ হয়ে যাচ্ছে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। আইনজীবীদের জন্য সেই টাকা আবার মক্কেলের কাছ থেকে আদায় করতে হচ্ছে। অনেক সময় আদায় করাও কঠিন হয়ে যায়। কোর্ট পুলিশ পরিদর্শক আসাদুজ্জামান আসাদ বদলী হয়ে বর্তমানে কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক আব্দুর রশিদ আসলেও সেই ঘুষ আদায় বানিজ্য সেটিং বহাল রয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক মামলাগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে কোর্ট পুলিশ মোটা অংকের টাকা আদায় করছেন।
৫ আগস্টের পূর্বে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের দোহাই দিয়ে বিএনপি জামাত ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলার এজাহার তুলতে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করেছে কোর্ট পুলিশ। ধান্ধাবাজির লক্ষ্যে মামলাগুলো থানায় দায়ের হলেও জিআরও রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করে রাখেনা। ৫ আগস্টের পূর্বেও রাজনৈতিক মামলাগুলো রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ না করে নিজেদের হেফাজতে রেখে হাজার হাজার টাকা কপি বিক্রি করেছিল কোর্ট পুলিশ।
এবার একই কায়দায় আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার এজাহার তুলতে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কোর্ট পুলিশ। সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া সোনারারগাঁও জিআরও অফিসের এএসআই রেহোনা আক্তার, কনেস্টবল রুবিনা আক্তার ও কনেস্টবল মনির হোসেন। এখনো মামলার এজাহার প্রতি আদায় করছে এক হাজার টাকা করে। এসআই আতিকুর রহমানও কম যাননি। তিনি বদলী হলেও চরিত্র বদলায়নি বাকীদের। তিনিও জামিন শুনানি প্রতি এক হাজার টাকা করে নিতেন। তার স্থলে দায়িত্বভার পেয়েছেন আড়াইহাজার জিআরও এর এসআই আমিনুল ইসলাম। তিনিও একই কায়দায় চালাচ্ছেন ঘুষ বানিজ্য।
আদালতপাড়া সুত্রে, মূলত মামলার কপি নেওয়া, হাজিরা দেওয়া, টাইম পিটিশন দেয়া, রিমান্ড বাতিলের শুনানি, জামিননামা দেওয়া, জামিনের শুনানি, মামলার নকল তোলাসহ মামলা সংক্রান্ত যে কোনো সেবায় বকসিশ বা খরচাপাতি ছাড়া এখন যেন চলেই না। এ ছাড়া জামিন শুনানির পুটআপ নিতে সংশ্লিষ্ট আদালতের কর্মচারী, পিয়ন, উমেদারদের ১০০ থেকে ২০০ টাকা দিতে হয়। এছাড়া রিলিজ অর্ডার বা মুক্তিনামা কারাগারে পাঠানোর আগে জামিননামা যাচাই করতে পুলিশের জিআর শাখায় দিতে হয় ১০০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত। কারাগার থেকে বের হতে দ্রুত রিলিজ অর্ডার কারাগারে পাঠাতে দিতে হয় আরো বেশি টাকা। আসামীর প্রতি হাজিরায় জিআর শাখায় সংশ্লিষ্ট থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশকে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা বা তারও বেশি দিতে হয়।
মামলার এজাহার নিজ টাকায় ফটোকপি করলেও পুলিশ আদায় করছে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। বিচারকের নিষেধ আছে এমন অজুহাত তুলে এএসআই রেহেনা আক্তার, কনেস্টবল রুবিনা আক্তার ও মনির হোসেন আদায় করে নেন আরো বেশি টাকা। জুনিয়র আইনজীবীদের বোকা বানিয়ে মোটা অংকের উৎকোচ আদায় করে এই তিনজন। চার্জশিটের ফটোকপি নেওয়ার জন্য কমপক্ষে ৫০০ টাকা নেন, মামলার এমসির ফটোকপি চাইলেও পাচশো হাজার নেন। এছাড়া জিআর মামলায় আসামির জামিননামা দাখিলের সময় ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। এছাড়া আদালতের হাজতখানা ও জেলখানায় ওকালতনামা স্বাক্ষরের জন্য ২০০ টাকা নেওয়া হয়। জেলখানার দ্রুত রিলিজের আদেশ পাঠাতেও দিতে হয় অতিরিক্ত টাকা। টাকা ছাড়া কোনো কাজ করতে চায় না তারা। টাকা কম দিলেও আইনজীবীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করে তারা। তাদের চাহিদামত টাকা না দিলে আসামীর জামিন হলেও প্রথম দিনে জেলখানায় যাবেনা জামিন আদেশের কপি ও রিলিজ। এভাবে কোর্ট পুলিশের কাছে জিম্মি হয়ে আছে বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরাও।