সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সবচেয়ে বেশি মাদকের ছড়াছড়ি ১৩নং ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায়। যার পশ্চিম প্রান্ত থেকে শুরু করে পূর্বে শীতলক্ষা নদী পর্যন্ত এলাকায় শত শত মাদক স্পট। নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রধান এলাকাও এটি। আর এই ওয়ার্ডে বসবাস করেন নারায়ণগঞ্জের বেশকজন আলোচিত সমাজপতি বিশিষ্ট ব্যক্তিরা, যারা সমাজে বেশ প্রতিষ্ঠিত। অনেক বিশিষ্টজনের বাড়ির দেয়াল ঘেষে গড়ে ওঠেছে মাদকের স্পট। শহরের ছিনতাইকারীদের আস্তানাও এই ওয়ার্ডের আনাচে কানাচে। এ ওয়ার্ডের অনেক বিশিষ্টজন জেলা ছেড়ে রাজধানী পর্যায়েও বেশ আলোচিত সম্মানিত। কিন্তু তারা তাদের একটি মাদকমুক্ত ওয়ার্ড গড়তেই ব্যর্থ হয়েছেন চরমভাবে।
জানাগেছে, অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার বসবাস করেন ১৩নং ওয়ার্ডের মাসদাইর এলাকায়। তিনি বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও দেশব্যাপী আলোচিত ব্যক্তি বিশিষ্টজন। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এপিলেড ডিভিশনের একজন আইনজীবী। বিআরটিসির সাবেক চেয়ারম্যান। এর আগে ছিলেন এডিশনাল এটর্নী জেনারেল। অথচ তার এলাকায় মাসদাইরের অনেক অলিগলিতে মাদকের স্পট। এর আগে জেলার শীর্ষ মাদক বিক্রেতা বন্দুক শাহিন পুুলিশের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হন। যার বাড়িও মাসদাইর এলাকায়। অভিযোগ আছে তাকে শেল্টার দিতেন বিএনপির সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম। এই আবুল কালাম যদিও বসবাস করেন ১৫নং ওয়ার্ডে। তৈমূর আলমের এলাকা হলেও তিনি কখনই মাদকমুক্ত করতে পারেননি এলাকাটি। যদিও তার ভাই সাব্বির আলম মাদকের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে গিয়ে খুন হন বলে দাবি করেন তিনি। প্রতি বছর একবার তার ভাই সাব্বির আলম খন্দকার হত্যার বিচার দাবিতে মাদকমুক্ত সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠনে জোড়ালো বক্তব্য রাখেন। পরক্ষণেই তিনি দমে যান।
নারায়ণগঞ্জ জেলার ক্রীড়াঙ্গনে কুতুব উদ্দীন আকসির বেশ সুনামখ্যাত একজন ব্যক্তি। ক্রীড়াঙ্গনে ভুমিকা রাখলেও তার বাসাটিও এই ওয়ার্ডের কলেজ রোড এলাকায়। তার বাড়ির পাশেই রেললাইন। প্রতিদিন রাতের বেলায় তার বাড়ির সামনেই দেখা যায় মাদক বিক্রেতাদের আনাগোনা। তিনি জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারের সঙ্গে এক টেবিলে বহুবার বসেছেন কিন্তু কখনই তিনি তার ওয়ার্ড থেকে মাদকমুক্ত করতে জোড়ালো বক্তব্য দেননি। দেনও না।
তারই পাশে বাড়ি রয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট এসএম ওয়াজেদ আলী খোকনের বাড়ি। তার আইন পেশার চেম্বারও রয়েছে রেললাইনের পাশে। তিনি নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামীলীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক। সমাজে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি তিনিও। কিন্তু তিনিও মাদকের বিরুদ্ধে জোড়ালো কোন পদক্ষেপ নেননি। তার চেম্বারের সামনেই রাত ১০টার পর দেখা যায় মাদক বিক্রেতাদের আনাগোনা। রেললাইনের পাশে তার চেম্বার আর সেই চেম্বারের সামনেই মাদক বিক্রি চলে হরদম। তার ওয়ার্ড মাদকমুক্ত গঠনে তেমন কোন ভুমিকা রাখেননি।
নারায়ণগঞ্জের শ্রমিক নেতাদের মধ্যে বেশ আলোচিত অ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান ইসমাইল। দাপটশালী এই শ্রমিক নেতার বাড়ি গলাচিপা এলাকায়। আশ্চর্যের বিষয় তার বাড়ির দেয়ালের সামনে দাড়িয়েই চলে হরদম মাদক বিক্রি। তিনি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু তার এলাকাটি তিনি মাদকমুক্ত করতে পারেননি। যদিও এর আগে তিনি মাদক বিরোধী অভিযান চালিয়েছিলেন এলাকাবাসীকে নিয়ে। উল্টো রাস্তায় যাকে তাকে সামনে পেয়ে করেছেন মারধর। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তার এলাকায় মাদকমুক্ত করতে গেট ও দারোয়ানের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু আবারো বাড়ছে মাদক বিক্রেতাদের উৎপাত। ব্যর্থ হয়েছেন তিনিও। এখন তার বাড়ির দেয়ালের সামনে দাড়িয়েই দেখা যায় মাদক বিক্রি করতে।
এই ওয়ার্ডে মাদকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি যার ভুমিকা থাকার কথা তার ভুমিকাও ব্যর্থতায়। মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ সিটি কর্পোরেশনের টানা দুইবারের ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। এর আগেও তিনি পৌরসভা থাকাকালীন সময়ে এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। কিন্তু তার ওয়ার্ডের মাসদাইর, গলাচিপা, কলেজ রোড, আমলাপাড়া, কুমুদিনি র্যালী বাগান, মাচ্ছাপাড়া এলাকা সহ প্রায় সব এলাকাতেই মাদকের ছড়াছড়ি। কিন্তু তিনিও মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর ভুমিকা নিতে পারেননি। মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে তিনিও চরম ব্যর্থ।
তবে দায় এড়াতে পারেন না সিটি কর্পোরেশনের সংরক্ষিত কাউন্সিলর শারমীন হাবিব বিন্নি। তার নির্বাচনী এলাকা এই ওয়ার্ডটি। তিনি নির্বাচনের সময় মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে এলাকাবাসীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু টানা দুইবার নির্বাচিত হলেও মাদকের বিরুদ্ধে তার কোন এ্যাকশন দেখা যায়নি। শহরের যেসব ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে তার বেশির ভাগই গলাচিপা রেললাইন মোড়ে। শহরের বিবি রোডে ছিনতাই করেই ছিনতাইকারীরা রেললাইন মোড়ে ঢুকে যায়। এটি সদর থানা ও ফতুল্লা এলাকার বর্ডার। যার সুযোগে ছিনতাইকারীদের আস্তানা হয়ে গেছে ওই বর্ডারটি। এ বিষয়ে এই দুই কাউন্সিলরকে কখনও জোড়ালো কোন বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি।
এই ওয়ার্ডের আমলাপাড়ায় বসবাস করেন আরেক বিশিষ্টজন কাশেম জামাল। তিনি একজন শিক্ষানুরাগী হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছেন। কিন্তু তিনি শিক্ষার আলো ছড়াতে কাজ করলেও মাদক তার শিক্ষার আলোতে ছোবল মারছে সেদিকে তার কোন হদিস নেই। তার মুখে এই ওয়ার্ড থেকে মাদকমুক্ত করতে জোড়ালো কোন বক্তব্য দেখা যায়নি। এমনকি তিনি আমলাপাড়া স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হলেও রাত ১২টার পর সেই স্কুলের সামনেই হরদম চলে মাদক বিকিকিনি।
নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও একজন ক্রীড়া সংগঠক রবিউল হোসেন। তিনি এই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে দুইবার নির্বাচন করেছিলেন। পরাজিত হলেও এলাকায় তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে বেশ। কিন্তু তার বাড়ির সামনেই দিনভর চলে মাদক বিকিকিনি। তার বাড়ির পাশর্^বতী তিনটি গলিতে মাদক ব্যবসায়ীদের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি। রাতের বেলা মাদকের ছড়াছড়ি চলে আরও বেশি। কিন্তু তার ভুমিকা রহস্যজনক নীরব। গলাচিপা চায়ের দোকান থেকে রূপার বাড়ির মোড় হয়ে চেয়ারম্যান বাড়ির গলি পর্যন্ত মাদক বিক্রেতাদের উৎপাত সবচেয়ে বেশি। এখানে ছিচকে সন্ত্রাসীদের উৎপাতও কম নয়। স্বচ্ছ মানুষ এ এলাকায় বসবাস করতে হিমশিম খাচ্ছে। ভাড়াটিয়াদের অব্যাহত হুমকি ধমকির উপর রাখছে এলাকার মাদক বিক্রেতারা। কেউ কিছু বলতে সাহস পায়না। ১৪/১৫ বছরের ছোট ছোট ছিচকে সন্ত্রাসী ও মাদক বিক্রেতাদের হাট বাজার বসে রাত ১০টার পর থেকেই। কিন্তু তিনি জনপ্রতিনিধি হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও তার বাড়ির চার পাশেই মাদকের ছড়াছড়ি।
নুরুল ইসলাম সর্দার। তিনি নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি। বর্তমানে রাজনীতিতে কিছুটা নীরব থাকলেও তিনি একটি প্রতিষ্ঠিত পরিবারের সন্তান। তিনি পৌরসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জনপ্রতিনিধি হতে চেয়েছিলেন। তার বসবাস শহরের আমলাপাড়ায়। কিন্তু তার বাড়ির চার পাশেই এখন মাদক বিক্রেতাদের উৎপাত। তার এলাকায় নারায়ণগঞ্জ আইন কলেজ। এই আইন কলেজ থেকে শত শত আইনজীবী তৈরি হয়েছেন। সন্ধার পর থেকে আইন কলেজটিই হয়ে ওঠে মাদকের হাট বাজার। মাচ্ছাপাড়া এলাকায়ও মাদকের ব্যাপক ছড়াছড়ি। কিন্তু মাদকের বিরুদ্ধে তার কোন ভুমিকা নেই।
আরও দায় এড়াতে পারেন না এ ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করা জেলা যুবলীগ নেতা শাহ মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ ফয়েজ, বিএনপির নেতা অ্যাডভোকেট এইচএম আনোয়ার প্রধান ও মহানগর আওয়ামীলীগের সদস্য সাখাওয়াত হোসেন সুমন। ফয়েজ উল্লাহ বসবাস করেন জামতলা এলাকায়। এই জামতলা এলাকার অলিগলিতেও রয়েছে মাদকের স্পট। আনোয়ার প্রধান ও সাখাওয়াত হোসেন সুমন বসবাস করেন মাসদাইর এলাকায়। তারা ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধি হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও তারা মাদকের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াচ্ছেন না। কখনও মাদকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে আসেননি।
স্থানীয়রা বলছেন- উপরোক্ত এসব বিশিষ্টজনেরা মাদক ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ভুমিকা রাখতে যেনো ভয় পান। মাঝে সাঝে মাদকের বিরুদ্ধে মৃদু সুর তুললেও আবার জোড়ালোভাবে মাদকের বিরুদ্ধে তারা কথা বলছেন না। নারায়ণগঞ্জে সামাজিকভাবে এসব বিশিষ্টজনেরা প্রতিষ্ঠিত হলেও মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের একটি সুষ্ঠু সুন্দর ওয়ার্ড গঠনে। এদের ছাড়াও এই ওয়ার্ডে বসবাস করেন অনেক প্রশাসনের লোকজন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাগণ, আইনজীবী, সাংবাদিক সহ সুশীল সমাজের অনেকেই। কিন্তু মাদক নির্মূলে তারা সোচ্চার হতে পারছেন না। ভয়ে কথা বলতে পারছেন না। চোখও দিচ্ছেন না এ বিষয়ে। তারা সমাজের চার দিকে নানা প্রসংশনীয় ভুমিকা রাখলেও তাদের নিজ ওয়ার্ডই ডুবে যাচ্ছে মাদকের জোয়ারে সেদিকে তারা চোখ ফেলছেন না। রাতের বেলা এসব এলাকায় রিক্সাওয়ালারাও রিক্সা নিয়ে আসতে চায় না। একটি সুষ্ঠু সুুন্দর সমাজ গঠনে তারা চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন বলে দাবি করছেন ওয়ার্ডের শান্তিকামী মানুষ।