সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশের উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। দেশকে ডিজিটাইলাইজেশনের আঁওতায় আনতে প্রযুক্তির ব্যবহারকে প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করছে। বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মেলাতে এর বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে নতুন কোন প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণহীনতা ও অজ্ঞতা থেকে শুরু হয় ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক। এ বিতর্কে বিতর্কিত হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা।
নানামুখি সংকটে প্রথমেই চলে আসে ডিজিটাল কারচুপি নামক বিতর্ক। এ সংকট সমাধানে সরকার বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও তা আশানুরূপ ফল পাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে গ্রাহক ও ভোক্তা পর্যায় এ পদ্ধতিগুলোর সুবিধা অসুবিধা জানা না থাকায় তৈরী হয়েছে ক্ষোভ। সংকট দেখা দিয়েছে আস্থার। ফলে প্রায় ভেস্তে যাচ্ছে ডিজিটাল পরিকল্পনার অন্যতম ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম পদ্ধতি।
অন্যদিকে সম্প্রতি পল্লী বিদ্যুতায়নসহ বিদ্যুৎ বিভাগে প্রি-পেইড মিটার স্থাপন নিয়ে গ্রাহকের রয়েছে নানা অভিযোগ। এসব অভিযোগের যথেষ্ট যুক্তিও রয়েছে। সরকারকে এসব প্রযুক্তি ব্যবহারের আগে জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা যাচাইয়ান্তে তা কার্যকর করার পরামর্শ তাদের।
এবার আসা যাক বাংলাদেশে কিভাবে শুরু হয়েছে এসব প্রযুক্তির অন্যতম এ দুটি পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক। কেনই বা এমন সংকট। শুরুতেই বলা যায়, বিগত বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ইভিএম মেশিন ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলে আসছে বহুদিন ধরে। বিতর্ক হিসেবে রাজনৈতিক বিবেচনায় এই মেশিন ব্যবহার দেশের জন্য সহায়ক কিংবাপ্রতিবন্ধকতা স্থান পায়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইভিএম পদ্ধতি চালু রয়েছে। এই পদ্ধতি প্রথম চালু হয় যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬০ সালে। এর ৪ বছরের মধ্যেই ৭টি রাজ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এ পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো হয়। এতোদিন যুক্তরাষ্ট্রের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতি নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু এ দেশের এর প্রয়োগের শুরুতেই দেখা দিয়েছে নানা বিতর্ক।
এ প্রসঙ্গে আলোচনার পূর্বে ইভিএম বিষয়ক কিছু কথা না লিখলেই নয়। মুলত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট প্রয়োগের মেশিন বা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি অণুসৃত হয় বলে সামগ্রিক প্রক্রিয়াটিকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম নামে বলা হয়। যা ই-ভোটিং হিসেবেও পরিচিত।
একটি মেশিনে প্রায় চার হাজারটি পর্যন্ত ভোট দেয়া যায়। সর্বোচ্চ ৬৪ জন প্রার্থীর তালিকা থাকে। বাটন চাপ দিয়ে অক্ষরজ্ঞানহীন ব্যক্তিও ভোট দিতে পারে। একটি ভোট দিতে আনুমানিক ১৪ সেকেন্ড সময় লাগে। একজন ভোটারের কোনভাবেই একটির বেশি ভোট দেয়ার সুযোগ থাকে না। সাধারণ ব্যালট ভোটের মতো কেন্দ্রেও সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে পোলিং এজেন্টরা, নেতাকর্মীরাসহ পর্যবেক্ষকরাতো থাকবেই। মেশিনটিতে একটি পূর্ব-প্রোগ্রামিং করা মাইক্রোচিপ থাকে যা প্রতিটি ভোটের ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে হিসেব করে প্রদর্শন করে। এতে ব্যালট কাগজে সিল মারার পরিবর্তে ভোটার পছন্দের প্রতীকের পাশের সুইচ টিপে ভোট দিতে পারেন। প্রতিটি বুথে একটি ইভিএমের প্রয়োজন পড়ে। এটি কয়েকটি ইউনিটে ভাগ করা থাকে। এসব ইউনিটের মধ্যে, ব্যালট ইউনিটটি থাকে বুথের ভেতর। এর মাধ্যমে ভোটার তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন। এছাড়াও কন্ট্রোল ইউনিট থাকে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের সামনের টেবিলে। একেক মেশিন চালাতে দরকার হয় ১২ ভোল্টের একটি ব্যাটারি। ব্যাটারিতে মেশিনটি সারাদিন চলতে পারে ফলে বাড়তি কোন বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় না। ফলে যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ থাকে না সেসব এলাকায় ভোট গ্রহণে কোন সমস্যা হয়না।
মোটকথা ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে যেসব সুবিধার কথা বলা হয় তার মধ্যে কোটি সংখ্যক ব্যালট ছাপানোর খরচ, কাগজের খরচ, এগুলো পরিবহনের খরচ, ভোট গণনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকবলের খরচ সবই সাশ্রয় হবে। নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী একটি জাতীয় নির্বাচনে এক হাজার ৮৭ কোটি টাকা খরচ হয়ে থাকে। কিন্তু ইভিএম পদ্ধতিতে একটি জাতীয় নির্বাচনে খরচ হবে মাত্র নয়শ’ কোটি টাকা। আবার একটি মেশিন দিয়ে চার-পাঁচটি জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব। চাইলে এটা ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন বা উপ নির্বাচনেও কাজে লাগানো যাবে। সেক্ষেত্রে শুধু মেশিনটিতে নতুন করে প্রোগ্রাম প্রবেশ করাতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় কোনো ভোটারের ভোট বাতিল হবে না। ভোটের তথ্য মেশিনে প্রায় ১০ বছর ধরে অবিকৃত অবস্থায় থাকবে।
এছাড়াও কেন্দ্র দখল করার অভিযোগে পেলে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার কন্ট্রোল ইউনিটের ক্লোজ সুইচটি চেপে দিলেই দখলকারীরা কোনো ভোট দিতে পারবে না। তাছাড়া ইভিএমের স্মার্ট কার্ড সরিয়ে ফেললেও মেশিনটি চালু করা যাবে না। আবার প্রতি মিনিটে ৫টার বেশি ভোট দেয়া যাবে না। ফলে কারচুপি রোধ করা সম্ভব। এতে খুবই কম সময়ে ভোট গণনার কাজ করা যায়।
সুবিধা যতই হোক। এ পদ্ধতির কিছু উন্নয়ন প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ পর্যন্ত নানামূকী সমস্যা দেখা দিয়েছে এ পদ্ধতিতে। তার মধ্যে প্রভাবশালীদের দ্বারা কেন্দ্র দখলের পর পোলিং এজেন্টদের নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটে। এমনটা ঘটলে নির্বাচন শেষে ক্লোজ বাটনে ক্লিক করলেই যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট কোনো প্রতীকে অতিরিক্ত ২০০/৩০০ ভোট যুক্ত করা সম্ভব। যা বিতর্কের জন্ম দেয়। এতে ফলাফল উল্টে দেয়া সম্ভব। এছাড়াও নির্বাচনী কর্মকর্তার স্মার্ট কার্ডের নকল কার্ড তৈরি করে ইভিএমের প্রোগ্রামকে পরিবর্তন করতে পারেন। এতে ফলাফলকে প্রভাবিত করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতা পেলে কোন প্রার্থীর কর্মীরা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে কয়েকশ মিটার দূর থেকেও কন্ট্রোল ইউনিট নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে। রয়েছে এসব মেশিনের মান নিয়ে প্রশ্ন। বাংলাদেশের ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনটি ভারতের মেশিনগুলোর কাছাকাছি মানের। ২০১০ সালের ১২ আগস্ট ‘ভারতের ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন জালিয়াতি প্রতিরোধক নয়’ দাবি করেছিলেন মার্কিন আইটি বিশেষজ্ঞরা। দেশে যে মেশিনটা তৈরি করা হয়েছে তা আধুনিক তবে অত্যাধুনিক নয় বলে দাবী করেছেন তারা।
সংবাদ সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর প্রায় ৮৫ ভাগ দেশেই এই পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছে। এর পেছনে মেশিন যতটা না দায়ী ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক ও অন্যান্য কিছু সমস্যা। বিশেষজ্ঞমহল মনে করছে জাতীয় নির্বাচনের মত বৃহৎ পরিসরে কেন্দ্র দখলের ঘটনা ঘটলে যে কোন দলের জন্যই এ পদ্ধতি হবে অনেক বেশি হতাশাজনক।
তবে আমাদের দেশে ২০১০ সালের ১৭ জুন অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে সফলতা আসে। সেখানে মোট ২৫ হাজার ২৩৮ জন ভোটার ইভিএমে ভোট প্রদান করেন।
এবার আসি দেশের বিদ্যুৎ বিভাগ নিয়ে। এ বিভাগের প্রতিবছর যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তার যথাযথ হিসাব রাখা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে যায়। আবার কখনো কখনো গ্রাহক পর্যায়ে নানা কারণে ৫ থেকে ৭ শতাংশ বিদ্যুৎ নষ্ট হয়। এ সমস্যা সমাধানে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো পদক্ষেপেই শতভাগ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তাই বিদ্যুতের অপচয় রোধ করতে এবং বিদ্যুতের যথাযথ হিসাব রাখতেই প্রিপেইড মিটার সিস্টেম চালু করতে শুরু করেছে এ বিভাগ। তবে নানা অভিযোগে এ পদ্ধতির সঙ্গে খাঁপ খাইয়ে নিতে পারছেন না গ্রাহকরা। তাদের অভিযোগ এ এতোদিন যে পরিমাণ বিল গুণতে হয়েছে এ মিটারের কারনে দ্বিগুণ তিনগুণ বিল দিতে হচ্ছে। এখানে নানা রকম চার্জ কাটার রয়েছে অভিযোগ। এমন নানা বিতর্ক নিয়ে সারাদেশে গ্রাহকরা ফুঁসে ওঠেছে। মানববন্ধন, বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচীতে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু গ্রাহক পর্যায়ে এর সুবিধা অসুবিধা নিয়ে কোন প্রচার প্রচারনা নেই। বা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে গ্রাহকরা বিষয়টা সম্পর্কে জানেই না বলে দাবী তাদের। এ প্রসঙ্গে যাবার পূর্বে এর সুবিধা ও অসুবিধা জানাতে চাই।
এ মিটার ব্যবস্থায় গ্রাহক ব্যবহারের আগেই বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করবেন। এতে মিটার রিডিং, বিল প্রণয়ন এবং আদায়ে কোনো ঝামেলা থাকে না। মিটারে প্রিপেইড সিস্টেম থাকায় গ্রাহক নির্দিষ্ট সীমার ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবেন না। গ্রাহক প্রয়োজনে মোবাইল কার্ডের মতো রিচার্জ কার্ড কিনে বা দরকার পড়লে ভেন্ডিং স্টেশনে গিয়ে নিজেই রিচার্জ করে নিতে পারবেন। এছাড়াও মিটারে টাকা শেষ হওয়ার আগেই গ্রাহককে মিটার সংক্রিয়ভাবে সংকেত দেবে। ফলে বিদ্যুৎ সঞ্চয়ে গ্রাহক আরো সচেতন হবেন।
প্রিপেইড মিটারের ক্ষেত্রে বিল দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত ঝামেলা পোহাতে হবে না। যেকোনো সময়ে গ্রাহক দেখতে পারবেন, তার কত বিদ্যুৎ খরচ হয়েছে আর কত অবশিষ্ট আছে। বিতরণ কোম্পানি বিদ্যুৎ দেওয়ার আগেই সব টাকা পেয়ে যাবে। ফলে বিল তৈরি ও বিতরণের ঝামেলা ও ব্যয় কমবে।
সর্বশেষ বিদ্যুৎ বিল বকেয়া হবে না। ফলে লাইন কাটার দুঃশ্চিন্তা থাকবে না। গ্রাহকরা তাদের বিদ্যুৎ বিলের ওপর ২ শতাংশ ডিসকাউন্ট পাবেন বলে। এভাবে নানাবিধ সুবিধার কথা মাথায় রেখে এ মিটার ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়েছে।
কিন্তু প্রিপেইড মিটারের টাকা রিচার্জের কেন্দ্র (ভেন্ডিং স্টেশন) চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন গ্রাহকরা। তাদের অভিযোগ ‘প্রিপেইড মিটারে ভোগান্তির শেষ নেই। রিচার্জ করতে না পারলে বিদ্যুৎহীন থাকা, অতিরিক্ত বিল আসা, পর্যাপ্ত রিচার্জ কেন্দ্র সহ মিটারের লিমিট বৃদ্ধি না করা, সেলফোনে সেবা না থাকা, প্রিপেইড মিটার রিচার্জ করার অনুমোদিত ব্যাংক ও শাখা প্রয়োজনের তুলনায় কম হওয়া। রিচার্জের জন্য ডেস্কেও আসন সংখ্যা সীমিত রাখার কারনে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে জানা যায়। তাই বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের গবেষণা ও নীতি-সহায়তা সংস্থার এ সমস্যা সমাধানে কার্যত ভূমিকা নিতে হবে। নচেৎ এ পদ্ধতির সুফল পাবে না গ্রাহকরা। আর যে পদ্ধতিতে গ্রাহকের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা থাকে না এসব সেবা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার কোন কারণ থাকার যৌক্তিকতা নেই। বিজ্ঞ মহল মনে করছেন এসব প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে সাধারন লোকজনকে প্রয়োগকৃত পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞাত করা।
অন্যথায় যতই ভালো ও সুবিধার কথা বলা হোক। বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে অজ্ঞ রেখে কোন প্রদ্ধতিই কাজে আসবে না। তাই প্রয়োজন যথাযথ প্রশিক্ষন, প্রচার ও এসবের সুফল ও নিরাপত্তা বিষয় নিশ্চিত করা।
লেখক: মাহবুব আলম প্রিয়
সাংবাদিক ও কলামিষ্ট