সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে নতুন করারোপ ছাড়াই (নাসিক) ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮৭০ কোটি ৩৯ লাখ ৭৭ হাজার ৭৬ টাকার অষ্টম বাজেট ঘোষণা করেছেন মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী। এই বাজেট গত বছরে ঘোষণা করা বাজেটের চেয়ে ১৫৪ কোটি ৮৮ লাখ ৫৫ হাজার ৬৯৯ টাকা বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৭১৫ কোটি ৫১ লাখ ২১ হাজার ৩৭৭ টাকা বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল।
১৪ জুলাই রবিবার দুপুরে নগর ভবন প্রাঙ্গণে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেন মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। এসময় বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানের মঞ্চে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীর প্রতীক)।
এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু, জেলার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূরে আলম সিদ্দিকী ও সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী এএফএম এহতেশামূল হক।
নাসিকের অষ্টম বাজেটে জলাবদ্ধতা নিরসন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন সহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাজেটে বিশেষ বরাদ্ধ রাখা হয়েছে।
বাজেটে রাজস্ব ও উন্নয়ন খাতে মোট ৮৭০ কোটি ৩৯ লাখ ৭৭ হাজার ৭৬ টাকা আয় (যার মধ্যে রাজস্ব খাতে ১৩৪ কোটি ৯৯ লাখ ১৫ হাজার ৩১৭ টাকা ও উন্নয়ন খাতে ৭৩৫ কোটি ৪০ লাখ ৬১ হাজার ৭৫৮ টাকা) আয় ধরা হয়েছে এবং ৮৬৫ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ২৪৭ টাকা (যার মধ্যে রাজস্ব খাতে ১১৩ কোটি ৪১ লাখ ৪৬ হাজার ২৫১ টাকা ও উন্নয়ন খাতে ৭৫১ কোটি ৭৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯৯৬ টাকা) ব্যয় ধরা হয়েছে। উদ্বৃত্ত রাখা হয়েছে ৫ কোটি ২২ লাখ ৬৪ হাজার ৮২৯ টাকা।
বাজেট ঘোষণার সময় মেয়র আইভী বলেন, এবারের বাজেট ঘোষণায় একটু নিয়মের ব্যতয় ঘটানো হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলায় প্রথমবারের মত মন্ত্রী পেয়েছে। তাই তাকে এবার আমন্ত্রণ জানিয়েছি। এরপর মেয়র বাজেট ঘোষণা শুরু করেন।
এবারের বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানে মেয়র আইভী বলেন, সবাইকে একটি সুখবর দিতে চাচ্ছি। কদমরসুল সেতু গত বছরের ৯ অক্টোবর একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করেছিলেন। ৫৯০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ১৩৮৫ মিটার দৈর্ঘ্য এবং সাড়ে ১২ মিটার বিশিষ্ট সেতুটি ৫নং ঘাট দিয়ে নির্মিত হবে।
তিনি জানান, সেতুটির নকশা অনুযায়ী নির্মাণ কাজের পরামর্শক নিয়োগ প্রায় সম্পন্ন হয়ে যাবে। আগামী ডিসেম্বর মাসেই প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে সেতুটির কাজের ভিত্তিপ্রস্তুর উদ্বোধন করা হবে।
মেয়র হিসেবে তৃতীয়বারের মতো বাজেট ঘোষণার সময় আইভী বলেন, গত অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটে প্রস্তাবিত অধিকাংশ উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করেছি। এ যাবৎ সিটি করপোরেশন ৫৪টি মাসিক সভায় ২ হাজার ৩৬৬টি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন করেছে। যার মধ্যে ৭৯২টি গৃহিত প্রকল্পের বিপরীতে ১ হাজার ৯০৩ কোটি ৬৯ লাখ ২৬ হাজার ১৬২ টাকার দরপত্র আহবান করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ১ হাজার ৩১৩ কোটি ৭৭ লাখ ৩ হাজার ৩১২ কোটি টাকার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ চলমান রয়েছে।
মেয়র বাজেট ঘোষণার সময় বলেন, সিটি করপোরেশন কঠিন বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার ইতিমধ্যেই প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। জালকুড়িতে ২৩ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন নাসিককে জায়গার দখলও বুঝিয়ে দিয়েছে। জায়গার সীমানা প্রাচীর তৈরির দরপত্র আহবান করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে বর্জ্য ফেলার যে সমস্যা তা এই প্রজক্টের মাধ্যমে সমাধান হবে বলে আশা করেন মেয়র। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য আবাসনের জন্য ৬টি বহুতল ভবন তৈরির অনুমোদন সরকার দিয়েছেন। এটির দরপত্রও আহবান করা হয়েছে।
টানবাজারের সুইপার কলোনীতে ২টি, ১৭ নংওয়ার্ডে দুইটি, ইসদাইরে ২টি মোট ৬টি দশতলা ভবন নির্মাণের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়েছে। রাস্তা, ড্রেন নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ ও বৃক্ষরোপনে এই অর্থবছরে প্রায় ৩০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এ ছাড়াও পঞ্চবটিতে নতুন করে জৈব সার উৎপন্ন করার জন্য একটি প্রজেক্ট নেয়া হয়েছে জানিয়ে মেয়র বলেন, ওই প্রজেক্টে পলিথিন বা পাস্টিক হতে কালো কার্বনের রূপান্তরের মাধ্যমে অপরিশোধিত তেল উৎপন্ন করা হবে। এতে বর্জ্যরে কাজে নিয়োজিত গাড়িতেই এই তেল ব্যবহৃত হবে।
বর্তমানে নাসিকের চলমান কয়েকটি কাজের কথা তুলে ধরে মেয়র বলেন, মিউনিসিপ্যাল গভার্নেন্স সার্ভিসেস প্রকল্পের (এমজিএসপি) আওতায় বিশ্বব্যাংক বাবুরাইল খাল খননের জন্য ২৫০ কোটি টাকা বাজেট দিয়েছেন।
ইতিমধ্যে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ধলেশ্বরী নদী পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার আমরা এই খাল খনন করছি। এই কাজের অগ্রগতি প্রায় ৩০ ভাগ। যথাসময়ে এই কাজটি আমরা শেষ করতে পারবো। এমজিএসপির মাধ্যমে ৫০/৬০ কোটি টাকার কাজ সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও কদমরসুল অঞ্চলে করা হচ্ছে।
মেয়র আইভী বলেন, জাপান আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা (জাইকার) অর্থায়নে সিটি গভার্নেন্স প্রকল্পের (সিজিপি) আওতায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকার কাজ চলমান আছে। এসবের মধ্যে রাস্তা-ঘাট, ড্রেন, খেলার মাঠসহ ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজ রয়েছে। এর বাইরে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নেও বিভিন্ন কাজ চলমান আছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেওভোগের শেখ রাসেল পার্ক। গত ১৬/১৭ বছরের চেষ্টায় নগরীতে একটি পার্ক করতে সক্ষম হয়েছি। খুব শীঘ্রই পার্কটি উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। জলাশয়টি সংরক্ষণ করতে পেরেছি। জল্লারপাড় খালের জন্যও আমরা টেন্ডার দিয়ে দিয়েছি।
নগরীতে আলাউদ্দিন খাঁ স্টেডিয়াম, আলী আহাম্মদ চুনকা স্টেডিয়াম, নাগ মহাশয়ের মাঠসহ বন্দরের সোনাকান্দা হাট-মাঠ, কদমরসুল মাঠ, দরগাহের কাজ, সিদ্ধিরগঞ্জের বিশাল লেক (১২৫ কোটি টাকার দরপত্র দেয়া হয়েছে) যাতে ৬টি সেতুর কাজ রয়েছে, লেকটিকে নান্দনিক করার জন্য লেকের পাড় ঘেঁেষ রাস্তা এবং একটি এমপি থিয়েটার করার কাজ চলমান রয়েছে।
মেয়র আইভী বলেন, নগরীর চারুকলা ইনস্টিটিউট ভেঙে দিয়েছিলাম। চারুকলাকে সংরক্ষণ করার জন্য ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে চারুকলা কলেজ ও হোস্টেল নির্মাণের দরপত্র আহবান করা হয়েছে। দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে নাসিক কাজ করছে। এবারও এখাতে অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ইউএনডিপি, ইউএসএইড, জাইকা, বিশ্বব্যাঙ্ক সহযোগিতা করছে।
এছাড়া বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানে সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক এমপি হোসনে আরা বেগম বাবলী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য আনিসুর রহমান দিপু, জাতীয় শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শ্রমিক উন্নয়ন ও কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাউসার আহমেদ পলাশ, বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আরজু রহমান ভূইয়া, আব্দুল কাদির, যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, নাসিকের প্যানেল মেয়র আফসানা আফরোজ বিভাসহ অন্যান্য কাউন্সিলরগণ, ডাক্তার, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
তবে এই অনুষ্ঠানে মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, এমপি নজরুল ইসলাম বাবু ও এমপি সেলিম ওসমানকে দাওয়াত করা হলেও দাওয়াত করা হয়নি নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী এমপি একেএম শামীম ওসমান ও এমপি লিয়াকত হোসেন খোকাকে। যে কারনে এই অনুষ্ঠানে যাননি এমপি সেলিম ওসমান। তিনি আগের দিনই বন্দরের একটি অনুষ্ঠানে অভিযোগ তুলেছেন বাজেট ঘোষণার অনুষ্ঠান নিয়ে মেয়র আইভী সূক্ষ রাজনীতি করেছেন।
বাজেট ঘোষণার পাশাপাশি জনগণের অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ‘জনতার মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পরে তিনি জনগণের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।